মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম অবস্থায় রাজনৈতিক দল ছিল দুটি— হ্যামিল্টনের ‘যুক্তরাষ্ট্রীয় দল’ (Federalist) এবং জেফারসনের ‘যুক্তরাষ্ট্র-বিরোধী দল’ (Jeffersonian Republicans of Anti-federalist)। যুক্তরাষ্ট্রীয় দল সংবিধানের ব্যাখ্যার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারকে শক্তিশালী করবার সমর্থক ছিল। অন্যদিকে জেফারসনের রিপাবলিক দল অঙ্গরাজ্যগুলির অধিকার সংরক্ষণের নীতি গ্রহণ করেছিল। ১৮০০ সালে জেফারসন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে ‘রিপাবলিকান দল’ ক্রমশঃ প্রাধান্য লাভ করতে থাকে। ‘যুক্তরাষ্ট্রীয় দল’ ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
চল্লিশ দশকে পুরানো দলীয় ব্যবস্থার পরিবর্তে দুটি নতুন রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব হয়— উদারনৈতিক (Whig) ও গণতান্ত্রিক (Democrat) দল। উদারনৈতিক দল শিল্পের সংরক্ষণ নীতির এবং সামাজিক সংস্কারের কর্মসূচী গ্রহণ করে। অন্যদিকে গণতন্ত্রী দল ক্রমশঃ রক্ষণশীল মনোভাব গ্রহণ করে। রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিংকনের সময় থেকে দাসত্ব প্রথাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দল দ্বিধাবিভক্ত হয়। দাসত্ব প্রথার বিরোধীগণ রিপাবলিকান বা সাধারণতন্ত্রী দল হিসাবে পরিচিত হয়। গণতন্ত্রী দলের সমর্থকগণ দাসত্ব প্রথাকে সমর্থন করতে থাকে। ষষ্ঠ দশকের গৃহযুদ্ধের সময় থেকে সাধারণতন্ত্রী দল ও গণতন্ত্রী দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আসছে। বর্তমানে ডিমোক্র্যাট দলের ভূমিকা প্রগতিশীল এবং রিপাবলিকান দলের ভূমিকা রক্ষণশীল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা [The Role of Political Parties in the United States]
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে কোনো রাজনৈতীক দলের উল্লেখ না থাকলেও রাজনৈতিক দল দুটি শাসন পরিচালনায় বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে, তাঁর দৈন্দদিন কার্যকলাপে, কংগ্রেসের আইন প্রণয়নে এমনকি বিচার ব্যবস্থার ওপর দলীয় ব্যবস্থা প্রভাব বিস্তার করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দলীয় ব্যবস্থার জন্য শাসন ব্যবস্থার জটিলতা বৃদ্ধি পেয়েছে সত্যি, কিন্তু দলগুলি জনমত সংহত করে তার প্রকাশের মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক দল কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে।
(১) মার্কিন জনগণকে সংঘবদ্ধ করে ঐক্যবদ্ধ বলিষ্ঠ জনমতের মাধ্যমে সরকারের নীতি ও কর্মসূচীকে জনকল্যাণমুখী করে তোলার জন্যে রাজনৈতিক দলগুলি কাজ করে।
(২) সমাজের বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক সমস্যাগুলি বাছাই করে জনগণের সামনে নির্বাচনের সময় উপস্থিত করে। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে কোন দল কিভাবে কোন সমস্যার সমাধান করবে তাও জনগণের সামনে উপস্থিত করে জনমত গঠন করার চেষ্টা করে।
(৩) গণতন্ত্রী দল বা সাধারণতন্ত্রী দল উভয় দলেরই মূল লক্ষ্য হল সরকারী ক্ষমতা দখল করা। উভয় দলের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য না থাকায় পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের চেষ্টা করা হয়।
(৪) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি বলবৎ থাকায় সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সহযোগিতার বন্ধন রচনা করে শাসনকার্যে ধারাবাহিকতা রক্ষা করার গুরু দায়িত্ব রাজনৈতিক দলই পালন করে।
(৫) জনগণের রাজনৈতিক শিক্ষা ও সচেতনতা সম্প্রসারণে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা উপেক্ষার নয়। উদারনৈতিক গণতন্ত্রকে সফল করার জন্য নাগরিকদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তোলা এবং শাসননীতি ও শাসনকার্যে আগ্রহী করে তোলার কাজ দলগুলি সম্পাদন করে। সভা-সমিতি, বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে দলগুলি বিভিন্ন সমস্যা ও কর্মসূচীর ব্যাপক প্রচার করে থাকে।
(৬) রাজনৈতিক জীবনে অসংখ্য স্বার্থগোষ্ঠী নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গীকে প্রতিফলিত করতে শাসন ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। রাজনৈতিক দলের মাধ্যমেই স্বার্থগোষ্ঠীগুলি নিজেদের দাবী-দাওয়া সরকারের কাছে উপস্থিত করে। স্বার্থের গ্রন্থিকরণ রাজনৈতিক দলের অন্যতম প্রধান কাজ। বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থাকে স্থায়িত্ব দান করার জন্য সাম্রাজ্যবাদী ও নয়া উপনিবেশবাদী নীতির দ্বারা উভয় দলই পরিচালিত হয়।