একটি দেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি যেমন অন্য দেশ থেকে আলাদা তেমনিভাবে বিভিন্ন দেশের সংবিধানের মধ্যেও পার্থক্য দেখা যায়। তবে কোনো দেশের সংবিধানের উৎকৃষ্ট দিকগুলি গ্রহণ করতে কোনো বাধা থাকে না। ভারতের পার্থক্য পূর্ণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, রাজনৈতিক চরিত্র অনুসারে অন্যান্য দেশের সংবিধান থেকে পৃথক হয়ে পড়েছে এবং কতকগুলি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে।
ভারতীয় সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্য (Features)
1. বৃহত্তম ও লিখিত সংবিধান (Largest and Written Constitution): ভারতের সংবিধান বিশ্বের সর্ববৃহৎ লিখিত ও জটিল সংবিধান। বিভিন্ন সময়ে সংবিধান-সংশোধনের পর বর্তমানে মোট 448টি ধারা (Articles), 12টি তপশিল (Schedules) এবং 25টি অংশ (Parts) রয়েছে।
2. প্রস্তাবনা (Preamble): ভারতীয় সংবিধানের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল সংবিধানের গোড়াতে একটি প্রস্তাবনার সংযুক্তি। ভারতীয় সংবিধানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ‘Declaration of Independence’-এর অনুকরণে একটি প্রস্তাবনা বা Preamble অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। প্রস্তাবনাকে ভারতীয় সংবিধানের দর্শন বা চালিকাশক্তি বলা যায়। প্রস্তাবনা অনুসারে ভারতবর্ষ একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, প্রজাতান্ত্রিক দেশ।
3. আংশিক সুপরিবর্তনীয় ও আংশিক দুষ্পরিবর্তনীয় (Partly Flexible and Partly Rigid): ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান সুপরিবর্তনীয়তা (নমনীয়তা) ও দুষ্পরিবর্তনীয়তা (কঠোরতা) উভয়েরই সংমিশ্রণ। ব্রিটেনের সংবিধানের সুপরিবর্তনীয়তা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের দুষ্পরিবর্তনীয়তার সমন্বয় সাধন করে ভারতীয় সংবিধান। সাধারণ আইনসভা সাধারণ আইন প্রণয়ন পদ্ধতিতে অনেক ক্ষেত্রে সংবিধানের পরিবর্তন সাধন করিতে পারেনা বলে ভারতের সংবিধানকে দুষ্পরিবর্তনীয় বলা হয়। কিন্তু ভারতের সংবিধান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো চূড়ান্ত রূপে দুষ্পরিবর্তনীয় নয়। সংবিধান সংশোধনীর জন্য অন্তত অর্ধেক রাজ্যের আইনসভার অনুমোদন প্রয়োজন।
4. পার্লামেন্টারি ব্যবস্থা (Parliamentary System): ব্রিটেনের পার্লামেন্টারি শাসনব্যবস্থার অনুকরণে ভারতীয় সংবিধানে সংশোধনীয় বা পার্লামেন্টারি শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছে। এই শাসনব্যবস্থায় একজন আনুষ্ঠানিক শাসক প্রধান থাকবে কিন্তু প্রকৃত শাসন ক্ষমতা পার্লামেন্টের নিকট দায়িত্বশীল এক মন্ত্রীমণ্ডলীর হাতে অর্পিত হবে। ভারতের রাষ্ট্রপতি হলেন আনুষ্ঠানিক শাসক প্রধান। আর প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রীমণ্ডলী প্রকৃত শাসনক্ষমতা পরিচালনা করেন। পার্লামেন্টের সংখ্যাগবিণ্ঠ দলের নেতাকে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীরূপে নিযুক্ত করেন।
5. যুক্তরাষ্ট্রীয় ও আধা-যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো (Federalism-Quasi-Federal Structure): ভারতীয় সংবিধান একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধান। 28টি রাজ্য ও 8টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল নিয়ে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হয়েছে। সংবিধানের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ও রাজ্যসরকারগুলির মধ্যে বণ্টিত হয়েছে। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের শাসনক্ষমতা তিনটি তালিকায়, যথা—কেন্দ্রীয় তালিকা, রাজ্যতালিকা ও যুগ্ম তালিকায় বণ্টিত হয়েছে। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রকে পূর্ণ যুক্তরাষ্ট্র বলা যায় না। ভারতীয় সংবিধানে আধা-যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রবণতা দেখা যায়। জরুরী সময়ে, কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যগুলির উপর বৃহত্তর নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে।
6. মৌলিক অধিকার ও কর্তব্য (Fundamental Rights and Duties): ভারতীয় সংবিধানে 12-35 নম্বর ধারায় (তৃতীয় অংশে) নাগরিকদের ছটি মৌলিক অধিকার—(i) সাম্যের অধিকার, (ii) স্বাধীনতার অধিকার, (iii) শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার, (iv) ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার, (v) সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক অধিকার এবং (vi) শাসনতান্ত্রিক প্রতিবিধানের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া 1976 সালে 42 তম সংবিধান-সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের 51A (চতুর্থ অংশে-Part IVA) ধারায় নাগরিকদের 11টি মৌলিক কর্তব্য পালনের নির্দেশ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। মৌলিক অধিকার আদালত কর্তৃক বলবৎযোগ্য।
7. নির্দেশমূলক নীতি (Directive Principles): আয়ারল্যান্ডের সংবিধানের অনুকরণে ভারতীয় সংবিধানে নির্দেশমূলক নীতি উল্লিখিত আছে। এর মাধ্যমে ন্যায়, সমতা, স্বাধীনতা ও সৌভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে এক নতুন জনকল্যাণকামী সমাজব্যবস্থা গঠনের অঙ্গীকার করা হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশমূলক নীতিগুলি সংবিধানের (চতুর্থ অংশে) 36-51 নম্বর ধারায় লিপিবদ্ধ রয়েছে। নির্দেশমূলক নীতি আদালত কর্তৃক বলবৎযোগ্য নয়।
8. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা (Independence of the Judiciary): বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হল ভারতীয় সংবিধানের ভিত্তিপ্রস্তর। সংবিধান অনুসারে ভারতের বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে। সংবিধানের ভারতীয় বিচার ব্যবস্থার সর্বোচ্চ সর্বোচ্চ আদালত হল সুপ্রিমকোর্ট। ভারতীয় সংবিধানের (চতুর্থ অংশে) 124-147 নম্বর ধারায় সুপ্রিমকোর্ট এবং সংবিধানের (ষষ্ঠ অংশে) 214-231 নম্বর ধারায় হাইকোর্টের উল্লেখ রয়েছে। ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ভারতের সুপ্রিমকোর্ট শক্তিশালী নয়। ভারতের সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিরা রাজনৈতিক দলের নেতা দ্বারা পরোক্ষভাবে পরিচালিত হয়।
9. এক নাগরিকত্ব (Single Citizenship): ভারতীয় সংবিধানে এক নাগরিকত্ব স্বীকৃত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সুইজারল্যান্ডে দ্বৈত নাগরিকত্বের বিধান রয়েছে। ভারত ব্রিটিশ সংবিধান (ব্রিটেন) থেকে এক নাগরিকত্বের ধারণা নেওয়া হয়েছে। সংবিধান অনুসারে জাতিধর্মনির্বিশেষে সব ভারতীয়কে একমাত্র ভারতীয়না গরিকতার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। ভারতীয়রা সকলেই ভারতের নাগরিক। ভারতীয় সংবিধানে (দ্বিতীয় অংশে) 5-11 নম্বর ধারায় নাগরিকত্বের ধারণা লিপিবদ্ধ রয়েছে।
10. ধর্মনিরপেক্ষতা (Secularism): সংবিধানে ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে। অর্থাৎ বিশেষ ধর্মকে ভারতীয় রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসাবে স্বীকার করা হয়নি। 1976 সালের 42 তম সংবিধান-সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের প্রস্তাবনায় “ধর্মনিরপেক্ষ” শব্দটি যুক্ত করা হয়েছিল। ভারতীয় সংবিধানে (তৃতীয় অংশে) 25-28 নম্বর ধারায় ধর্মনিরপেক্ষতা ধারণা লিপিবদ্ধ রয়েছে।
11. দলত্যাগ বিরোধী আইন (Anti-Defection Law): 1985 সালে 52 তম সংবিধান-সংশোধন করে ভারতে দলত্যাগ বিরোধী আইন প্রবর্তিত হয়। এটি সংবিধানে দশম তপশিলে যোগ করা হয়েছে। সংবিধানের 102 ও 191 ধারার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে দলত্যাগের জন্য পার্লামেন্ট বা রাজ্য আইনসভা সদস্যপদের বাতিল করবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট 1991 সালের নভেম্বর মাসে এক রায়ে দলত্যাগ-বিরোধী আইনের বৈধতা স্বীকার করে। 2003 সালে 91 তম সংবিধান-সংশোধনীর মাধ্যমে ভারতে দলত্যাগ বিরোধী আইনকে শক্তিশালী করা হয়েছিল।
12. সংরক্ষণ (Reservation): ভারতীয় সংবিধানে শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং তফসিলি জাতি (SC), তফসিলি উপজাতি (ST), অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণী (OBC), এবং অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল বিভাগগুলির (EWS) জন্য সংরক্ষণ কোটা প্রদান করা হয়েছে। মূল সাংবিধানিক বিধানগুলির মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য অনুচ্ছেদ 15(4), 15(5), এবং 15(6) এবং সরকারি চাকরির জন্য 16(4) এবং 16(6) রয়েছে। এই সংরক্ষণ ব্যবস্থার লক্ষ্য পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়গুলির জন্য পর্যাপ্ত প্রতিনিধিত্ব এবং সুযোগ নিশ্চিত করার মাধ্যমে সামাজিক সমতাকে উন্নীত করা।
13. সংখ্যালঘু অধিকার (Minority Rights): ভারতীয় সংবিধান সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষার জন্য বেশ কিছু সুরক্ষা ও অধিকার প্রদান করে, যাতে তারা তাদের জাতি, সংস্কৃতি, ভাষা বা ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্যের শিকার না হয় তা নিশ্চিত করে। ভারতীয় সংবিধানের 29-30 নম্বর ধারা সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেয়।
14. সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার (Universal Adult Suffrage): ভারতীয় সংবিধানে জাতিধর্মবর্ণ, স্ত্রীপুরুষ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনীনির্ধন-নির্বিশেষে দেশের সব প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের ভোটাধিকার স্বীকৃত। সংবিধানে 326 নম্বর ধারা এবং পার্লামেন্ট প্রণীত জনপ্রতিনিধিত্ব আইনবলে ভারতে সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের অধিকার রয়েছে। ভোট দেওয়ার বয়স প্রাথমিকভাবে 21 বছর নির্ধারণ করা হয়েছিল কিন্তু 1988 সালে 61 তম সংবিধান-সংশোধনী আইন দ্বারা 18 বছর করা হয়েছিল।
15. সংবিধানের প্রাধান্য (Supremacy of the Constitution): মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের অনুকরণে ভারতের সংবিধানের প্রাধান্য স্বীকৃত হইয়াছে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে ভারতে সংবিধানের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যাবতীয় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এবং নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের উৎস হল সংবিধান। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারসমূহ, বিচারবিভাগ, আইনবিভাগ এবং দেশের সমস্ত প্রতিষ্ঠান ও নাগরিকবৃন্দ সবাইকে সংবিধানের অধীনে থেকে কাজকর্ম সম্পাদন করতে হয়। সংসদ কর্তৃক গৃহীত যেকোন আইন অবশ্যই সংবিধানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে নতুবা সুপ্রিম কোর্ট দ্বারা বাতিল করা যেতে পারে।
উপসংহার (Conclusion)
ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর দেশকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠে একটি সংবিধান। সংবিধান হল মৌলিক আইন। ভারতীয় সংবিধানের প্রকৃতি প্রজাতান্ত্রিক আধা-যুক্তরাষ্ট্রীয়। 1949 সালের 26 শে নভেম্বব গণপরিষদ কর্তৃক ভারতের সংবিধান 395 টি ধারা, 8 টি তপশিল এবং 22 টি অংশ সমেত গৃহীত হয় এবং 1950 সালের 26 শে জানুয়ারী স্বাধীন ভারতের সংবিধান কার্যকর হয়।