‘সেলভি’ (Selvi) একটি মালগুড়ি-ভিত্তিক ছোটো গল্প। লেখক আর. কে. নারায়ণের (R.K. Narayan) অনেক গল্প কাল্পনিক শহর মালগুড়িকে ভিত্তি করে রচিত হয়েছে। অনেক তুচ্ছ জিনিসও নারায়ণের কলমের যাদুস্পর্শে চমৎকার রূপলাভ করেছে।
প্রতিটি সঙ্গীতানুষ্ঠানের শেষে তাঁকে (সেলভি) স্বাক্ষর সংগ্রহকারীর দল ঘিরে ধরত। তাঁরা এমনভাবে সেলভিকে পরিবেষ্টিত করত যে, তাঁকে মঞ্চ পরিত্যাগ করতেই দিত না। সেই মুহূর্তে মোহন ধীরে ধীরে নির্গমনের রাস্তার দিকে অগ্রসর হত। ফিরে দাঁড়াত এবং হলঘরের অন্যপ্রান্ত থেকে ডাকত। “সেলভি তাড়াতাড়ি কর। তুমি কি ট্রেন ছেড়ে দিতে চাও?”
সে হয়ত বলতে পারত, “এখনও অনেক সময় হাতে রয়েছে।” কিন্তু মোহনের আদেশ অগ্রাহ্য করার অভ্যাস তাঁর ছিল না। জনসমক্ষে সেলভিকে আদেশ করা ও তাঁর ওপরে স্বীয় কর্তৃত্ব ফলাবার সুবর্ণ সুযোগ মোহন হাতছাড়া করত না। তারপর সে তাঁর দেহরক্ষা করার জন্য অপেক্ষারত একদল অনুরাগী ভক্ত ও সেলভির দিকে, বিশেষ করে সেলভিকে লক্ষ্য করে গাড়ির দিকে তাকিয়ে আপাত ঠাট্টার ভঙ্গিতে মন্তব্য করত, “ওকে ছেড়ে দাও, ও গাড়ির মধ্যে বসে বসে বিশ্বের যত অটোগ্রাফের খাতা আছে সবগুলি শেষ বিচারের দিন অবধি ভর্তি করে দেবে; ওর কোন সময়ের জ্ঞান নেই।”
জনতা তাঁকে এক বিরল স্বর্গীয় সত্তা রূপে বিবেচনা করত। তবে সেই একমাত্র ব্যক্তি যে ব্যক্তিগতভাবে তার নিজস্ব মুখমণ্ডল কেমন তা জানত। সে যখন প্রথম তাকে দেখেছিল তখন আপন মনে মন্তব্য করেছিল “দেখতে মন্দ নয় তবে উন্নতি সাধন প্রয়োজন।” তার প্রচণ্ড রূপে সমৃদ্ধ ভ্রূযুগল সুবিন্যস্ত এবং ধনুকাকৃতি। তার গাত্রবর্ণ কোন মতেই উজ্জ্বল নয়। কিন্তু ঠিক সীমারেখার ওপর সে আবিষ্কার করেছিল যথাযথ ত্বকের ক্রীম ও ট্যালকম যা তার ভ্রূ ও গণ্ডদ্বয়কে কালো আভাযুক্ত তালগোলপাকানো শ্রেণীবিন্যাসের অংশ দান করেছিল। মোহন চায়নি যে কেউ তাকে সন্দেহ করুক যে, সে প্রসাধনী ব্যবহারে উৎসাহ যুগিয়েছিল। সে ছিল মহাত্মা গান্ধীর অনুগামী এবং কয়েক বছর সে কারাগারে কাটিয়েছিল। নিজের হাতে বোনা কাপড় পড়ত এবং যাবতীয় বিলাস ব্যসন এড়িয়ে চলত। তাঁর স্ত্রীর ব্যক্তিত্বকে বৃদ্ধি করার জন্য আধুনিক এবং কৃত্রিম সহায়তা আকাঙ্ক্ষা করার কোন প্রশ্নই ছিল না। তবে বিশেষ কোন এক ধাপে সে আবিষ্কার করেছিল সিঙ্গাপুরে সেলভির একজন খুবই অনুরক্ত ভক্ত সকলের অগোচরে যোগাযোগের মাধ্যমে বিশেষ ধরনের প্রসাধনী দ্রব্য পাঠাত। ঐ ব্যক্তি সেগুলি নিয়মিত সরবরাহ করার আদেশ পেতে ও সেগুলিকে গোপন রাখতে খুবই সম্মানিত বোধ করত।
যখন সেলভি মঞ্চে আবির্ভূত হত, তাঁকে কালো, বাদামী অথবা হালকা বর্ণ নয় বরং বেশী উজ্জ্বল দেখাত আর যখনই প্রশ্নটি উঠত তখন জনতা অনুমান করত এবং বিতর্ক করত, যে সেলভির চামড়ার প্রকৃত রঙ কি। যেখানেই তাঁর ভক্তরা জড়ো হত সেখানেই সেলভির জীবনের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে চর্চা করা হত। এই চর্চাটা বিশেষ করে চলত বোর্ডলেস রেঁস্তোরার মত জায়গায় যেখানে সচরাচর আগত ব্যক্তিদের জন্য সংরক্ষিত টেবিলে কফি পান করতে করতে যথেষ্ট পরিমাণ শহুরে কথাবার্তার আদান-প্রদান করা হত। মালিক ভার্মা তাঁর আসনে বসে বসে এই ধরনের আলোচনা আড়ি পেতে শুনতে ভালবাসত, বিশেষ করে আলোচনার বিষয়টি যদি হত সেলভি। সে ছিল তার উপাসনাকারীদের মধ্যে একজন, তবে দূর থেকে প্রায়শই সে ভাবত দেবী লক্ষ্মী আমাকে অনুগ্রহ করেছে। আমার সম্পদ অথবা সমৃদ্ধির জন্য চাইবার জন্য বেশি কিছু নেই, তবে অন্য দেবীর অনুগ্রহ লাভের জন্য প্রবল আকাঙ্ক্ষী। সেই দেবী হলেন সরস্বতী, যিনি আমাদের মধ্যে ঐশ্বরিক গায়িকা সেলভি রূপে এসেছেন। সে যদি প্রসন্ন হয়ে আমার হাত থেকে এক কাপ কফি অথবা মিষ্টি গ্রহণ করে, তবে তা আমার পক্ষে কত গৌরবের বস্তু হত। কিন্তু মোহন সেই সামগ্রীটা গ্রহণ করে এবং গাড়িবারান্দা থেকে একটি আনুষ্ঠানিক ধন্যবাদসূচক শব্দ বলে আমার দিকে পশ্চাৎ ফিরায়।
দর্শনার্থীরা সারাদিন ধরে তাঁকে দর্শনের জন্য আসতে থাকে কিন্তু অল্প কিছু লোক তাঁর সংস্পর্শে পৌঁছতে পারত। কিছু লোককে নীচতলায় অভ্যর্থনা জানানো হত। কিছু লোককে উঠানে অভ্যর্থনা করা হত, কিছু লোককে ওপরতলায় যেতে উৎসাহিত করা হত কিন্তু কেউই তাঁকে একনজরে দেখতে পারে না, কেবলমাত্র মোহনের সচিব কিম্বা সচিবের সচিবই তার দেখা পেত। যাহোক নির্দিষ্ট ব্যক্তিত্বরা ওপরতলার প্রধান হলঘরে পেত আনুষ্ঠানিক সাদর সম্ভাষণ এবং গদি আঁটা আসনে তাদের বসানো হত। সাধারণ দর্শনার্থীদের আসন দেওয়া হত না, কিন্তু তারা এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা যে কোন বেঞ্চ বা চেয়ারে বসত এবং যতক্ষণ খুশি অপেক্ষা করার পর যেখান থেকে আগমন করত সেখানেই প্রত্যাবর্তন করত।
তাদের বাসভবনটি ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আমলের দালানবাড়ি। ধনুকাকৃতির খিলান, স্তম্ভ এবং কানাওয়ালা ছাদের ধারের দেওয়ালের ত্রিকোণাকৃতি দ্বারা সুসজ্জিত স্থাপত্যশিল্পের বিরল নিদর্শন। একদা এটি ছিল স্যার ফ্রেডারিক লওলের বাসভবন (যার মূর্তিটি শহরের স্কোয়ারে দণ্ডায়মান ছিল), যিনি চল্লিশ জনের একটি ভৃত্যের দল রেখেছিলেন, ছয়টি অতিকায় আকৃতির হলঘরওয়ালা দোতলা বাড়িটিকে ঝাঁট দিতে এবং ধুলো-ময়লা পরিষ্কার করতে। এই দোতলা ভবনটিতে ছিল দীর্ঘকায় দরজা ও গথিক শৈলীতে নির্মিত জানালা এবং ভেনেসীয় খড়খড়ি আর সেটি স্থাপিত ছিল কয়েক একর জমির ওপর এবং শহর থেকে পাঁচ মাইল দূরে মেপল হিলস্ যাওয়ার রাস্তার ওপরে। জায়গাটিতে বিরাট বিরাট গাছের বাগান তৈরি ছিল। বিশেষ করে গেটের সামনে ছিল বিদেশ থেকে রফতানি করে আনা একটি এলম গাছ (অথবা ওক্ গাছ কিম্বা বীচ্ গাছ সঠিক করে কেউ বলতে পারে না)। স্যার এফ, লওলে যিনি তাদের চারাগুলি ইংল্যান্ড থেকে আনিয়েছিলেন, এই গাছগুলি লাগিয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে যে ভারতবর্ষে এই একমাত্র উক্ত শ্রেণীর বৃক্ষ। কেউই বাড়িটিকে ভাড়া নিত না। কারণ এই ধারণা প্রচলিত ছিল যে স্যার ফ্রেডারিকের প্রেতাত্মা ওই জায়গা দিয়ে ঘুরে বেড়াত। সেই সময় মালগুড়ি শহরে বহু ভুতুড়ে কাহিনী চালু ছিল। 1947 সালে যখন ব্রিটিশ ভারত ছেড়ে চলে গিয়েছিল তখন পর্যন্ত বাড়িটি পরিত্যক্ত ছিল। এর মধ্যে কোন এক সময় মোহন বাড়িটি পাবার চেষ্টা করেছিল। সে বলত, “আমাকে চেষ্টা করতে দাও। গান্ধিজীর অসহযোগ আন্দোলন ব্রিটিশ শাসনমুক্ত করেছিল। আমি ছিলাম গান্ধীর একজন একনিষ্ঠ অনুগামী। সেই একই কৌশল দ্বারা আমি অন্তত স্থানটিকে একটা ব্রিটিশ ভূত থেকে মুক্ত করতে পারব নিশ্চয়।” সে বাড়িটি কেনার টাকা জোগাড় করেছিল যখন সেলভি তার কণ্ঠস্বর একজন চিত্রতারকাকে ধার দেওয়ার বিনিময়ে পারিশ্রমিক পেয়েছিল। সেলভির গানের সাথে সাথে সে শুধু তাল মিলিয়ে তার ঠোঁট নেড়েছিল এবং একটি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য এই রূপে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছিল। কিন্তু এরপর মোহন নিশ্চিতরূপে সমস্ত রকম চলচ্চিত্রে সুযোগদানের প্রস্তাব সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করেছিল। “আমি সেলভিকে তার নিজস্ব অনন্য বাহ্যমূর্তিতে প্রতিষ্ঠিত করব, একজন স্থূলদেহী প্রসাধন সজ্জিত নকল বস্তুর কণ্ঠস্বর হয়ে নয়।”
একটু একটু করে শ্রমসাধ্য প্রচার এবং মৌখিক কথার সুপারিশ দ্বারা, প্রতিটি সাংবাদিক এবং সংগীত সমালোচকের আনুকূল্য প্রচুর পরিমাণে জয় করে সে তার ভাবমূর্তি বর্তমানকালের গৌরবান্বিত অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত করেছিল।
বছরের পর বছর ধরে কঠোর শ্রম ব্যয় করতে হয়েছিল। সবশেষে যখন ফল ফলল তখন তার নামে এক অনন্য যাদু মুগ্ধতা অর্জন করেছিল। প্রতি সপ্তাহে একটা না একটা পত্র-পত্রিকায় তার ছবি প্রকাশিত হতে লাগল। সর্বত্র তার চাহিদা। মোহনের অফিসটি দেশের সমগ্র অঞ্চল থেকে আগত সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজকদের ভীড়ে ভর্তি থাকত। সে কাউকে বলত, ‘আপনার প্রস্তাবটি আমার সচিবের কাছে রেখে যান, আমরা আমাদের গায়িকার দিন তারিখ ঠিকঠাক করার পর আপনাকে জানিয়ে দেব। অন্য কাউকে বলত, ‘আমাদের কর্মসূচী 1982 সাল পর্যন্ত নিশ্ছিদ্র, যদি কোন একটি বাতিল হয় তখন আমরা দেখব কি করা যেতে পারে। 1981 সালের অক্টোবরে আমাকে মনে করিয়ে দেবেন। আমি আপনাকে একটা চূড়ান্ত জবাব জানাব।’ সে কতকগুলো প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করত একমাত্র কারণে, যেটা হল সেলভির অসাধারণত্ব (দুষ্প্রাপ্যতা) বজায় রাখা। যখন মোহন একটি চুক্তি মেনে নিত তখন আবেদনকারী (বরং বলা যায় সনির্বন্ধ আবেদক) অতিরিক্ত পারিশ্রমিক নেওয়া সত্ত্বেও খুবই কৃতজ্ঞতা অনুভব করত যদিও বিনা রসিদে তৎক্ষণাৎ তার অর্ধাংশ নগদ অর্থে ব্যয় করা হত। সে মাঝে মধ্যেই তার কৌশল পরিবর্তন করত। সে স্পষ্ট করে বলত যে, একটি বিশেষ সঙ্গীতানুষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত অর্থ কোন এক কেতাদুরস্ত সমাজ সেবামূলক সংগঠনের তহবিলে জমা হবে যার পৃষ্ঠপোষকদের তালিকায় সুপরিচিত লোকদের নাম বহন করছে। সে এই অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশনের জন্য কোন পারিশ্রমিক গ্রহণ করবে না বটে কিন্তু নগদ অর্থে খরচাপাতি দাবি করত যা তার স্বাভাবিক ফি-এর আসন্নমানের সমান। সে ছিল একজন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ সে জানে কেমন ভাবে টাকা উৎপাদন করতে হয় এবং একই সময়ে আয়কর ফাঁকি দিতে হয়। সে তার প্রাঙ্গণে এবং ঘরদালানে অস্থিরভাবে হেঁটে বেড়াত। তার মন সর্বদা ব্যস্ত থাকত কেমনভাবে নর- নারীদের সংগঠিত করতে হবে এবং কৌশলে পরিচালিত করা হবে সেই পরিকল্পনায়। হঠাৎ সে থেমে যেত, তার স্টেনোগ্রাফারকে ডেকে পাঠাত এবং ডিকটেশন দিত অথবা ফোন তুলে নিয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে তার মাধ্যমে কথা বলত।
প্রকৃত পেশাগত ব্যাপারের সহিত মোহন জনসংযোগের ওপরও নজর রাখত। সে বাছাই করা একমাত্র কিছু পার্টিতে উপস্থিত হত। লাল টেরাসে বিশিষ্ট পুরুষ ও মহিলাদের ভোজে আপ্যায়ন করত। অতিথিদের মধ্যে ছিটে-ফোঁটা দু’একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিও উপস্থিত থাকত। তার দেওয়ালে ঝুলে থাকত তার নিজস্ব ও সেলভির গ্রুপ ফটো, তাদের সাথে থাকত বিস্ময়কর ব্যক্তিত্বের দল—টিটো, বুলগানিন, ইয়েহুদি মেনুহিন, জন কেনেডি, নেহেরু পরিবার, পোপ, চার্লি চ্যাপলিন, যোগীগণ এবং খেলোয়াড়গণ এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। এই আলোকচিত্রসমূহ বিভিন্ন অবস্থায় ও পরিস্থিতিতে তোলা হয়েছে।
বোর্ডলেসে সেলভির প্রথম জীবন সম্পর্কে অনবরত চর্চা করা হত। ভার্মা সেই গল্পগুজবের টেবিলের আলোচনা থেকে শুনত যে, বিনায়ক মুদালী স্ট্রীটের একটি পেছনের গলিতে একটি ভগ্ন ও জীর্ণ টালির বাড়িতে সেলভিকে তার মা প্রতিপালন করেছিল। তাদের হাতে এমন যথেষ্ট নগদ অর্থ ছিল না যার দ্বারা টালির চালে পুনরায় ঢাকনা দেওয়া যেত। আর সে তার মায়ের কাছেই সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিল। তার ভাই ও বোন তাদের যন্ত্র দ্বারা সহযোগিতা করত।
এই সময় মার্কেট রোডে মোহনের একটি ফটো স্টুডিও ছিল। একদা সেলভি সংগীত প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিল, তাই এক স্কুল ম্যাগাজিনের জন্য ছবি তোলার জন্য তার মা মেয়েটাকে নিয়ে সেখানে এসেছিল। তারপর থেকে মোহন তাদের একজন শুভাকাঙ্ক্ষীরূপে মাঝে মাঝে প্রায়ই দেখতে যেত। এবং সাধারণত পরিবারটিকে পরামর্শ ও পথনির্দেশের মাধ্যমে একজন সদাশয় দেবতার মত ব্যবহার করত। কখনও কখনও সে সেলভিকে গান করতে অনুরোধ করত এবং তারপর নাটকীয়ভাবে চেয়ার ছেড়ে মেঝের ওপর এক পায়ের ওপর আর এক পা আড়াআড়ি করে রেখে বসে এমন ভঙ্গীতে চোখ বন্ধ করে গভীর মনোনিবেশ করে থাকত যে সে যেন বুঝাতে চাইত যে এরকম একজন প্রেরণাময়ী শিল্পীর উপস্থিতিতে একটি উচ্চস্থানে চেয়ারে বসে থাকা তার পক্ষে অপমানকর।
দিনের পর দিন, সে পরিবারটির প্রতি ছোট-খাট সেবা কার্য প্রদর্শন করত এবং তারপর ক্রমে তাদের সব ব্যাপারেই কর্তৃত্ব গ্রহণ করল। বোর্ডলেসে কেউ একথা নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারল না যে, ঠিক কোন সময়ে সে সেলভিকে তার স্ত্রী হিসেবে প্রকাশ করতে শুরু করে। অথবা কোথায়, কখন, কিম্বা কেমনভাবে তাদের বিয়ে হয়েছিল। কেউই এখন খুব ঘনিষ্ঠভাবে সে তদন্ত করতে চায় না।
মোহন লাল টেরাস কেনার জন্য চলচ্চিত্র থেকে উপার্জিত অর্থ বিনিয়োগ করতে একটুও দেরী করেনি। দেওয়ালে চুন ও রঙ করে বাড়িটাকে নতুন প্রাণ সঞ্চার করে এক শুভদিনে সে গফুরের ট্যাক্সি ভাড়া করে সেলভি ও তার পরিবারসহ টেরাসে এসে ওঠে।
ছয়টি বড় বড় হলঘর পেরিয়ে যেতে যেতে যখন তার মা, ভাই ও বোন উত্তেজিতভাবে বাড়িটির মাত্রা দেখতে লাগল, উচ্চ ছাদের দিকে তাকাতে লাগল এবং জিব দিয়ে ক্লীক ক্লীক শব্দ করতে লাগল তখন সেলভি কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল না। সে বাড়িটির মধ্য দিয়ে এমনভাবে যেতে লাগল যেন, কোন যাদুঘরের দরদালান। মোহন সামান্য হতাশ হয়েছিল এবং জিজ্ঞেস করল: ‘এ জায়গা তোমার কেমন লাগছে?’ এর উত্তরে সে বলেছিল, ‘বেশ বড় দেখাচ্ছে।’ পরিচালিত ভ্রমণের শেষে সে বাড়ির ইতিহাসেরও বর্ণনা দিতে লাগল (নাছোড়বান্দার মত বার বার ঘোরার কথা চেপে গেল)। সেলভি শুনতে লাগল কিন্তু কোন প্রকার আকর্ষণ দেখাল না। মনে হল তার মনটা পড়ে আছে অন্যত্র। তারা সকলে কোম্পানির আমলের গদিওয়ালা প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড বেঞ্চের ওপর বসেছিল। ওগুলি অন্যান্য সম্পত্তির সহিত আনা হয়েছিল কিন্তু নড়ানো সম্ভব ছিল না বলে ফেলে যাওয়া হয়েছিল। সে যে আরাম কেদারাটির ওপর বসেছিল তার বিশালতার প্রতি ভূক্ষেপ করল বলে মনে হল না। বাস্তবিক পরবর্তীতে তাদের শত শত সঙ্গীতানুষ্ঠানের জন্য ভ্রমণকালে সে উপলব্ধি করল যে সেলভি তার পারিপার্শ্বিক জগৎ সম্পর্কে উদাসীন। যে কোন পরিবেশে সে প্রাসাদোপম ভবন হোক কিম্বা বিলাসবহুল অতিথিশালা ও পরিচারক সমৃদ্ধ পাঁচতারা হোটেলই হোক: কিম্বা বিশেষ সুবিধাবিহীন অথবা গোপনীয়তাহীন ছোট শহর বা গ্রামই হোক সর্বত্র তাকে সমান নিরাসক্ত ও তৃপ্ত দেখাত; ধোয়ামোছা, পোশাক সজ্জিত এবং সন্ধ্যাকালীন নির্ধারিত সঙ্গীতানুষ্ঠানের ঠিক সময় একদম ফিটফাট ও রেডি হয়ে থাকত। বেশির ভাগ দিন সে কখনও জানত না কিম্বা জানতে চাইতও না যে কোথায় তাকে গাইতে হবে বা কত পারিশ্রমিক তারা পাচ্ছে। যখনই মোহন বলত, ‘বাঁধাছাদা করে রেডি হয়ে নাও।’ সে সঙ্গে সঙ্গে একটি ট্রাঙ্কের মধ্যে তার কাপড় চোপড়, প্রসাধন সামগ্রী এবং বলবর্ধক ওষুধের বড়ি ভরে প্রস্তুত হয়ে নিত, এমনকি কোথায় তারা যাচ্ছে সে প্রশ্নটি পর্যন্ত করত না। ট্রেনের মধ্যে সে একটি সংরক্ষিত সিটে বসত যখন তাকে সেখানে বসতে বলা হত এবং যখন মোহন তাকে সতর্ক করে দিত যে তাদের পরবর্তী স্টপে নামতে হবে তখন নামার জন্য তৈরি হয়ে যেত। সেলভি ছিল নির্দাবী, অকৌতূহলী, অভিযোগহীন। তাকে মনে হত কোন কিছু বা কালের প্রতি ভূক্ষেপ না করে কোন গোপন সঙ্গীতে বা নিজস্ব চিন্তায় গভীরভাবে মগ্ন হয়েই বেঁচে আছে।
ক্রমে এক-চতুর্থাংশ শতাব্দীর মধ্যে সে একজন জাতীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিল, দেশের ভেতরে এবং বাইরে ভ্রমণ করত। লোকেরা তাকে সঙ্গীতের দেবী নাম দিয়েছিল। যখন তার নাম ঘোষণা করা হত তখন যে কোন হলঘরই হোক তা কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যেত। আসন দখলের জন্য জনতার মধ্যে লড়াই বেধে যেত। সে যখন মঞ্চে আবির্ভূত হত তখন শ্রোতৃমণ্ডলী রোমাঞ্চিত হয়ে যেত, যেন স্বানুগ্রহে সে দর্শন দিতে আবির্ভূত হয়েছে। বজ্রনির্ঘোষে তাকে অভিনন্দিত করা হত। যখন সে বসে পড়ত, ধীরে ধীরে গলা পরিষ্কার করত এবং যন্ত্রসহযোগীদের যন্ত্রপাতির সুরের সহিত গুনগুন্ করে গলা মেলাত তখন সমস্ত শ্রোতৃমণ্ডলীর মধ্যে নীরবতা নেমে আসত। সকলের কাছেই তার আবেদন সমান ছিল—অতিসাধারণ নির্ভেজাল শ্রোতাদের কাছেও যেমন, তেমন পণ্ডিতদের নিকট, তত্ত্ববাগীশদের নিকট এবং সঙ্গীত বিজ্ঞানীদের নিকট একই রকম। এমনকি যারা সঙ্গীত নিয়ে মাথা ঘামাত না তারাও সম্মান বাঁচানোর স্বার্থে তার সঙ্গীতানুষ্ঠানে উপস্থিত হত।
যে কোন একটি সংগীতানুষ্ঠান কালে যে কোন স্থানে তা অনুষ্ঠিত হোক না কেন—মাদ্রাজ, দিল্লী, নিউইয়র্ক অথবা বিদেশ যেখানেই হোক, সেখানকার অডিটোরিয়ামে প্রথম সারির কেন্দ্রীয় আসনটি মোহন অধিকার করে থাকত এবং গায়িকার প্রতি তার এমন নিশ্চল দৃষ্টি নিবদ্ধ করে থাকত যে লোকেরা বিস্ময়ের সহিত ভাবত যে সে কি তার যাদুতে বিমোহিত হয়ে আছে নাকি ভাব পরিবহনের মাধ্যমে তাকে প্রেরণা যোগাচ্ছে। যদিও তার চোখ দুটি নিবদ্ধ থাকত সেলভির প্রতি কিন্তু তার মন ব্যস্ত থাকত অর্থনৈতিক সমস্যাসমূহ বিষয়ে জটিল পাটিগণিত নিয়ে এবং সে চোরা দৃষ্টিতে নজর রাখত কোন টেপরেকর্ডার কেউ চোরাচালান করে হলের ভেতরে নিয়ে আসত কিনা। সে কখনও অনুষ্ঠান রেকর্ড করার অনুমতি দিত না এবং চতুরতার সহিত লক্ষ্য করত তার আশপাশের ভি.আই.পি. দের প্রতিক্রিয়া।
সে প্রতিটি সংগীত অনুষ্ঠানের পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিকল্পনা রচনা করত। বিকেলবেলায় সে ঘুমাত না। সেলভির সহিত বসে বসে তাকে শান্ত অথচ দৃঢ়তার সহিত পরামর্শ দিত। ‘তুমি সামান্য এক কল্যাণী ভার্নাম দিয়ে শুরু করতে পারতে না?’ এবং সে বলত, ‘হ্যাঁ’। এছাড়া জীবনে সে দ্বিতীয় কোন শব্দ উচ্চারণ করতে সমর্থ হয়নি। সে বলে যেত “দ্বিতীয়টি থ্যাগারাজার বেগাড়া গানটি গাইলে আরও ভাল হত। বিপরীত রাগ হিসেবে এটা ভালই হত’ এবং তারপর তালিকাটি পূর্ণ হতে প্রায় চারঘণ্টা কেটে যেত। ‘এই ধরনের শ্রোতৃমণ্ডলীর জন্য কোন পল্লবী বিস্তার করাতে যেও না, তবে টোড়ি রাগটি একটু সংক্ষেপে গাইবে। এরপর তোমার পছন্দ মত কোন গান অতিরিক্ত গাইতে পার, হালকা ভজন হোক, জাভালি অথবা কোন লোকসংগীত।’ তাকে এমন স্বাধীনতা দেওয়া হল যা প্রকৃতপক্ষে অর্থহীন কেননা অনুষ্ঠান যেভাবে সাজানো হয়েছিল যা সঙ্গীতানুষ্ঠানের জন্য নির্ধারিত সময়টিতে কোন ফাঁক রাখা হয়নি। নিয়মানুসারে এই সময় চারঘণ্টা অতিক্রম করার কোন সুযোগ ছিল না। তবে আমার পরিকল্পনা এবং পরিচালনা ব্যতীত সে সব কিছু ভেস্তে দিত কেউ সে কথা উপলব্ধি করতে পারত না।
সকলে মোহনের আনুকূল্য ও শুভেচ্ছা পাওয়ার জন্য তাকে তোষামোদ করত এই আশায় যে এতে করে সে তাদের তারকার সান্নিধ্যে নিয়ে যেতে পারবে। মোহন একটি বিশেষ শ্রেণীর লোককে তার সাথে সাক্ষাৎ করতে উৎসাহ দিত এবং সে তাদেরকে লনে, টেরাসের সেন্ট্রাল হলে অভ্যর্থনা জানাত। যখন এরকম লোক আসত তখন সে সেলভিকে জোরে জোরে ডাকত। ‘এই যে দেখ অমুক অমুক এসেছেন।’ এ কোন সাধারণ লোকের নাম নয়- শুধু একজন মন্ত্রী কিম্বা একজন পুলিশের আই জি, অথবা কোন বস্তুকারখানার ম্যানেজিং ডাইরেক্টর বা কোন সংবাদপত্রের সম্পাদক, যে তার পালা এলে সব সময় মোহনকে কিছু আনুকূল্য দেখাতে আগ্রহ প্রকাশ করত এই আশায় যে এভাবে পরিবারের একজন বিশেষ বন্ধু হিসেবে শেষ পর্যন্ত সেলভির সহিত পরিচিত হতে পারে। তাকে ডাক দেওয়ার দশ মিনিট পর সেলভি তার চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসত এবং নিখুঁতভাবে তার ভূমিকায় অভিনয় করে যেত।
এক বিস্ময়কর স্মিত হাসি এবং দু’হাত জোড় করে নমস্তে বলত, যা মাননীয় দর্শনার্থীর শিরদাঁড়ায় শিহরণ খেলে যেত, যে দর্শনার্থী তার সর্বশেষ সঙ্গীতানুষ্ঠানটির প্রসঙ্গ টানত এবং স্বীকার করত কত গভীরভাবে তাকে নাড়া দিয়েছে এবং কোন এক বিশেষ রাগ তার কানে সেই অনুষ্ঠানের দীর্ঘদিন পরেও সেই সমস্ত সন্ধ্যা ধরে অনুরণিত হচ্ছিল। এই ধরনের প্রশংসার জবাবে সেলভি যথার্থ লাইনগুলি ব্যক্ত করত। অবশ্যই আমি সম্মানিত বোধ করি যে, আমার যৎসামান্য প্রচেষ্টা দ্বারা আপনার স্তরের ব্যক্তিকে মুগ্ধ করতে পেরেছি। এই সময় মোহন নাক গলাত, হয় কোন পরিহাস তামাশা অথবা কোন ব্যক্তিগত মন্তব্য করত। সে চাইত না কোন দর্শনার্থী সে যত বড় মাপেরই হোক না কেন কেউ যেন তার মনোযোগ ধরে রাখতে না পারে তবে এই মনোযোগ সে সঠিক মুহূর্তে সে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করে নিত। পরিশেষে মোহন এই ভেবে পরিতৃপ্তি লাভ করত যে, তার দেওয়া শিক্ষা পদ্ধতি, আদবকায়দা এবং বাচনভঙ্গী যথাযথভাবেই সেলভি পেশ করত। সে তাকে ওরকম সার্থকভাবে একজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের রূপ দিতে পারায় নিজেকে ধন্যবাদ দিত। ‘তবে আমার প্রচেষ্টা ব্যতীত সে তার মা, ভাই-এর মত বিনায়ক মুদালী স্ট্রীটের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত সন্তানের একটি রূপান্তর মাত্র তৈরি হত। আমি খুবই আনন্দ বোধ করি তাকে অত সুন্দরভাবে প্রশিক্ষণ দিতে সক্ষম হয়েছি।’ এই প্রক্রিয়ায় সে দ্রুত বিনায়ক মুদালী স্ট্রীটের সংক্রমণ থেকে পৃথক হয়ে পড়েছে। সে ক্রমান্বয়ে অতি সূক্ষ্মভাবে তার মা, ভাই এবং বোনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে আরম্ভ করল। যতই সময় পেরিয়ে যেতে লাগল, সেলভি দেখল সে তাদের কাছে দুর্লভ হয়ে উঠছে। শুরুতে সপ্তাহে একবার একটি গাড়ি পাঠানো হত তাদের নিয়ে আসার জন্য। যেহেতু সেলভির জনগণের সহিত কাজকর্ম বাড়তে লাগল তার মা এবং অন্যান্যরা ক্রমান্বয়ে তার জীবন থেকে স্নান হয়ে যেতে লাগল। সেলভি এক-দুবার তার মায়ের সম্পর্কে মোহনের সহিত আলোচনা করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তাকে বিরক্ত দেখাত এবং বলত, ‘তারা নিশ্চয় ঠিকঠাক আছে, আমি তাদের আনার ব্যবস্থা করব—কিন্তু এর জন্য সময় কোথায়? আমরা যখন বাড়িতে কমপক্ষে তিনদিন থাকতে সমর্থ হব, তখন আমরা তাদের এখানে পাব।’ এই ধরনের বিরতি ছিল বিরল ঘটনা। সাধারণত তারা হয় ট্রেনে বা গাড়িতে করে বাড়িতে আসত এবং তারপর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আবার বাড়ি থেকে চলে যেত।
কোন উপলক্ষে যখন সময় পায় তখন যদি সে ভয়ে ভয়ে তার মায়ের কথা উল্লেখ করে তবে মোহন প্রায় পুরোপুরি বিরক্তিভরে বলে, ‘আমি জানি, আমি জানি, আমি মনিকে বিনায়ক স্ট্রীটে পাঠাব-তবে অন্য কোন সময়। আমরা আগামীকাল রাজ্যপালকে মধ্যাহ্নভোজনে নিমন্ত্রণ করেছি এবং তাঁরা চাইবেন তুমি গান গাইবে, অবশ্য প্রথাগতভাবে নয়, কেবল মাত্র ত্রিশ মিনিটের জন্য।’ সেলভি দ্বিধান্বিতভাবে দাবী জানাত, ‘তার পরদিন?’ আর সে তখন সেলভিকে উপেক্ষা করত এবং টেলিফোনে কথা বলার জন্য সে স্থান ছেড়ে চলে যেত। সেলভি বুঝত ব্যাপারটা আর তাই সে নিজে থেকেই পরিস্থিতির কাছে আত্মসমর্পণ করত এবং পুনরায় কখনও তার মায়ের উল্লেখ করত না। গোপন ক্রোধে বারবার সে ভাবত, ‘যদি আমার নিজের মা-ই আমাকে দেখতে না পারে।’ তার অনুভূতির কথা ব্যক্ত করার মত কেউ ছিল না।
মোহন যখন দেখল সেলভি তার মাকে নিয়ে তাকে আর বিব্রত করছে না তখন এটা অনুভব করে খুশী হল যে সেলভি তার সম্বন্ধে মোহমুক্ত হয়েছে। এটাই ঠিক উপায়। একটি শিশুই শুধুমাত্র তার মাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সে যেভাবে মেয়েটিকে নিয়ন্ত্রণ করছে সেজন্য নিজেকে ধন্যবাদ দিত।
এইরূপে মাস গেল, বছর গেল। সেলভি তার কোন হিসাব রাখল না, কিন্তু একটি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মত তার জীবন অতিবাহিত হতে লাগল। আদেশ পেলেই গান শুরু করে আবার আদেশ পেলে গান বন্ধ করে দেয়।
যখন তার মায়ের মৃত্যু সংবাদ তার নিকট পৌঁছল তখন তারা কলকাতায় পরপর অনেকগুলি অনুষ্ঠানের জন্য এসেছিল। যখন এ-খবর তার কাছে পৌঁছল তখন সে তার হোটেলের ঘর থেকে বের হতে অস্বীকার করল এবং সমস্ত রকম কর্মসূচী বাতিল করতে বলল। মোহন তার কক্ষে গিয়ে তাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে যখন তার অশ্রুসজল চোখ ও আলুথালু কেশ দেখতে পেল তখন সত্বর নিজেকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে এল। ফিরতি ট্রেন ভ্রমণের সময় সমস্ত রাস্তা সে জানালার বাইরে সর্বক্ষণ তাকিয়ে রইল এবং একটিও কথা উচ্চারিত করল না। যদিও মোহন তার সাধ্যাতীত সবকিছুই করল তাকে কথা বলাবার জন্য। সে তার মনের অবস্থা দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। যদিও সে স্বভাবত বাচাল নয়। অন্ততঃপক্ষে তাকে যা বলা হত তা শুনত এবং ঘটনাক্রমে কখনও কখনও এক অক্ষরবিশিষ্ট মন্তব্য করে আলোচনা সংক্ষিপ্ত করত। এখন একটানা ছত্রিশ ঘণ্টার ভ্রমণকালে সে না বলল একটি কথা, না তাকাল তার দিকে ফিরে। তারা যখন বাড়ি পৌঁছল সে তৎক্ষণাৎ তাকে বিনায়ক মুদালী স্ট্রীটে নিয়ে যাওয়ার সমস্ত আয়োজন করল এবং নিজেও তার সঙ্গে গেল মৃতের প্রতি প্রথাগত সম্মান দেখানোর মানসে। তার মনে মনে ধারণা ছিল এর ফলে সেলভি তাকে প্রশংসা করবে। বড় গাড়ি এবং মোহনের পরনের সাদা ধপধপে হাতে বোনা কাপড় সেখানকার পারিপার্শ্বিকতার সহিত বেমানান ছিল। সেলভির মা যেখানে বাস করত মোহনের গাড়িখানি সেই রাস্তার অর্ধেক বন্ধ করে দিয়েছিল। তার বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। তার সন্তানেরা সিঙ্গাপুর থাকত। সেও এসে পৌঁছাল না। তার ভাইয়ের বর্তমান অবস্থান কোথায় তা জানা ছিল না। একজন প্রতিবেশী বৃদ্ধা মহিলার মৃত্যুজনিত পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে এগিয়ে এল। সে কিভাবে মৃতদেহের ভার নিয়েছিল আর পরবর্তী ঘটনাগুলো ঘটেছিল সেই ব্যাখ্যা করল। মোহন তার বর্ণনাকে সংক্ষেপ করতে বলল এবং তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল কারণ পূর্বনির্ধারিত ব্যক্তি ছাড়া সেলভির নিকটে যাওয়া ও তার সহিত কথা বলা বেআইনী। কিন্তু সেলভি মোহনকে বলল, “তুমি যদি চাও তবে টেরাসে ফিরে যাও, আমি এখানেই থাকছি।” মোহন আশা করেনি যে সে এইভাবে তার সঙ্গে কথা বলতে পারে। সে বিভ্রান্ত হয়ে গেল এবং বিড়বিড় করে বলল, “অবশ্যই….. তুমি যখন চাইবে তখন আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেব।”
“কখনও না….. আমি পূর্বে যেমন ছিলাম তেমনি করে এখন এখানে অবস্থান করব।”
‘সে কি করে সম্ভব এই গলিতে।’ সেলভি তার আপত্তি অগ্রাহ্য করে বলল, ‘আমার মা হলেন আমার গুরু। এখানেই তিনি আমাকে সঙ্গীত শিখিয়েছেন, বাস করেছেন ও মারা গেছেন।….. আমিও এখানে বাস করব এবং এখানেই মারা যাব। তার কাছে যা ভাল ছিল, আমার কাছেও তা ভাল।’
সে কখনও সেলভিকে এতটা নিষ্ঠুর অথবা বাকপটু বলে জানত না। সে বছরের পর বছর এত শান্ত ও সৌজন্যপূর্ণ ছিল, যে সে কখনও ভাবেনি সে যা শিখিয়েছে সেলভি তার বাইরে কিছু বলতে পারে কিম্বা কোন আচরণ করতে পারে। সে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল এই আশা নিয়ে যে, তার মনোভাবের পরিবর্তন হবে। ইতিমধ্যে বৃদ্ধা প্রতিবেশীটি তার বর্ণনা চালিয়ে যাচ্ছিল। তার বর্ণনা থেকে বৃদ্ধার শেষ মুহূর্তের কোন খুঁটিনাটি বিষয় বাদ পড়ছিল না। তিনি বলছিলেন শেষ কার্য করার সময় যে সমস্যা দেখা দিয়েছিল তারও কোন বিষয় বাদ গেল না, ‘আমিও জানতাম না কোথায় গেলে তোমার কাছে পৌঁছানো যাবে। তাই শেষ পর্যন্ত আমরা তার শবদেহ বহন করে নদীর ওপারে নিয়ে গেলাম এবং আমার নিজের হাতে চিতা জালালাম আর দেহাবশেষ ভাসিয়ে দিলাম সরযূর জলে। মোটের ওপর আমি তাকে বাল্য বয়স থেকেই চিনতাম। আর তোমার মনে আছে, আমি কেমনভাবে ‘আন্টি’ বলে ডাকতাম এবং বসে বসে শুনতাম তুমি রেওয়াজ করছ… ওহ! না, অবশ্য এখনকার দিনে নয়। আমি একটা টিকিট কেনার মত টাকা জোগাড় করতে পারি না। কিম্বা যেখানে তুমি গান কর তার ধারে কাছে কোথাও যেতে পারি না।’
মোহন আতঙ্কের মধ্যে সবই লক্ষ্য করল। সে কখনও ইতিপূর্বে ভাবতে পারেনি যে, সেলভি তার লেখা ভাষ্য অপেক্ষা অতিরিক্ত কিছু বলতে পারে। সাক্ষাৎকার সমাপ্ত করার জন্য তার সঙ্কেত পাওয়ার পর সে কখনও কারও সঙ্গে একটি কথা বলেনি অথবা সঙ্গীদের মধ্যে এক মুহূর্তও অপেক্ষা করত না, নিজেকে সরিয়ে নিত। আজ তাতে কোন কান দিল না। সে তার সঙ্কেতকে গ্রাহ্য করল না এবং বিনায়কের প্রতিবেশী অঞ্চল থেকে আগত লোকটি প্রচণ্ড উত্তেজনার সহিত বলে যেতে লাগল অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ঘটনাবলী। সে এই অদ্বিতীয় ঘটনা উপলক্ষে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পেরে বিজয়ীর আনন্দ জানাল।
অধৈর্যের সহিত অপেক্ষা করার পর, মোহন যাওয়ার জন্য উঠল, ‘তোমার জন্য কিছু পাঠাব কি?’ সে উত্তর দিল, ‘কিছুই না।’ সে লক্ষ্য করল সেলভি একটি ছেঁড়া শাড়ি পরে আছে এবং কোন মেকআপ নেয়নি বা কোন গয়না পরেনি। সে সমস্ত কিছুই টেরাসে রেখে এসেছে।
‘তুমি কি বলতে চাইছ কিছুই তোমার প্রয়োজন নেই?’
‘আমার কোন কিছুর দরকার নেই।’
‘তাহলে কিভাবে তুমি সব কিছুর ব্যবস্থা করবে?’ সেলভি কোন জবাব দিল না। মোহন দুর্বলভাবে জানতে চাইল, ‘তোমার ভূপালে অনেকগুলি সংগীত অনুষ্ঠান নির্দিষ্ট রয়েছে। আমি কি তাদেরকে তারিখ পরিবর্তন করতে বলব?’ এই প্রথমবার সে এ-ধরনের সমস্যা নিয়ে সেলভির সহিত আলোচনা করছে।
সে কেবলমাত্র বলল, ‘তোমার যা ভাল লাগে তাই কর।’
‘এর দ্বারা তুমি কি বুঝাতে চাও?’ কোন জবাব নেই।
সে বাইরে পা বাড়াল এবং গাড়ি চালিয়ে চলে গেল। এই গাড়িটি পূর্বে ভীড় আকর্ষণ করত কিন্তু আজ সে আকর্ষণ সেলভির প্রতি ঘুরে গেছে। তারা এগিয়ে এসেছে সেলভিকে দেখতে যা এতদিন ছিল এক বিরল মাপের বিলাসিতা, এই বছরগুলিতে যে দুর্গটি ছিল অভেদ্য। বেশিরভাগ লোকের কাছে সেলভি ছিল কেবল একটি জনশ্রুতি ও একটি জনপ্রিয় কাহিনী। কেউ একজন বলল, “তুমি কেন তোমার মায়ের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে না? সে তোমাকেই খুঁজছিল।” এ কথা শুনে সেলভি ভেঙে পড়ল এবং কান্নায় আলোড়িত হতে লাগল।
তিনদিন পর মোহন পুনরায় এসে ঘোষণা করল, ‘৩০ তারিখ দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে তোমাকে একটি সাম্মানিক ডিগ্রী নিতে হবে।’ সেলভি অসম্মতিসূচক ভঙ্গীতে মাথা নাড়াল। ‘প্রধানমন্ত্রী এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন।’
যখন চাপাচাপি করা হল তখন সে শুধুমাত্র বলল, ‘দয়া করে আমাকে এসবের বাইরে থাকতে দাও, এখন থেকে আমি একাকী থাকতে চাই। আমি কারো উপস্থিতি সহ্য করতে পারি না…..।’
‘শুধুমাত্র এই একটি কর্মসূচী। এরপর তোমার যা ইচ্ছে হয় তাই কর। অন্যথায় ব্যাপারটা সন্দেহপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে। কেবলমাত্র দিল্লীতে একটিমাত্র দিন। শীঘ্রই আমরা আবার ফিরে আসব। এছাড়াও তুমি আগামী মাসে গ্রামোফোনে রেকর্ডিংয়ের জন্য চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেছিলে।’ কিন্তু সে কোন উত্তর দিল না। তার চাহনিতে একথা প্রকাশ পাচ্ছিল যে, সেটা তার ব্যাপার নয়। ‘তুমি আমাকে বিপদে ফেলবে। কমপক্ষে বর্তমান প্রতিশ্রুতিটি।’ জনতার ভীড় তাদের আলোচনার প্রতিটি কথা লক্ষ্য করছিল এবং শুনছিল; এই অবস্থায় এই আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার অসুবিধা ছিল। সে ভাবল তার সাথে কিছু গোপনীয়তা থাকা দরকার।
সে ভাবতে লাগল সেলভির সঙ্গে তার কিছু গোপনীয়তা থাকা দরকার। কিন্তু এটা একটা এক কক্ষবিশিষ্ট বাড়ি যেখানে সকলেই আসে, দাঁড়িয়ে থাকে, ঘুরে বেড়ায় বা যে কোন জায়গায় বসে পড়ে। সে যদি তাকে একাকী পেত সে হয় তাকে মিষ্টি কথায় ভোলাত অথবা তার ঘাড় মটকে দিত। সে অসহায় ও মরীয়া অবস্থা অনুভব করতে লাগল এবং অকস্মাৎ সম্পূর্ণ ঘুরে সে স্থান পরিত্যাগ করল। কিন্তু এক সপ্তাহ পরে সে আবার এল। কিন্তু এতে কোন উন্নতি প্রমাণিত হল না। সে তাকে না জানাল অভিনন্দন, না বলল চলে যেতে। সে তাকে পরামর্শ দিল গাড়িতে এসে উঠতে। এবার সে তার ছোট গাড়িখানা নিয়ে এসেছিল, সেলভি তার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করল। মোহন মন্তব্য করল, ‘মোটের ওপর ওই মহিলার মারা যাওয়ার মত যথেষ্ট বয়স হয়েছিল। এই পাষণ্ডই সেলভির জীবন ধ্বংস করে দিচ্ছিল…..।’
মোহন আরও চার সপ্তাহ শোক পালন করবার অনুমতি দিল এবং তাঁর সঙ্গে পুনরায় দেখা করল, কিন্তু দেখল তাঁর বাড়ির সামনে বিরাট ভিড়। বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে রাস্তায় উপচে পড়ছে। সে ছোট্ট হলঘরের পেছনে বসেছিল, সেলভি তানপুরা ধরে শ্রোতাদের সামনে গান করছিল। একজন বেহালাবাদক ও একজন ঢোলবাদক স্বেচ্ছায় তাঁর সহযোগী যন্ত্র বাজিয়ে সাহায্য করছিল। সে ভাবল, ‘এই মহিলা তাঁর শিল্পকে একটু একটু করে ক্ষয় করে ফেলছে। সেলভি বলল, ‘এসো, বস।’ সে এক কোণে বসল। কিছুক্ষণ সঙ্গীত শুনল, তারপর সন্তর্পণে চলে গেল। বার বার সে তাঁর সহিত সাক্ষাৎ করতে লাগল এবং দেখল দিনের সর্বক্ষণ লোকে তাঁকে ঘিরে থাকে, তার সংগীত শোনার অপেক্ষায় থাকে। তাঁর নিখরচায় সঙ্গীত অনুষ্ঠানের সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল, সেখানে মানুষ গাড়িতে করে, বাইকে করে, বাইসাইকেলে করে এবং হেঁটে এসে গাদাগাদি ভিড়ের সৃষ্টি করতে লাগল। বোর্ডলেসের ভার্মা একটা গিল্টি করা কাগজে মোড়া মিষ্টির বাক্স উপহারস্বরূপ এনে নিঃশব্দে সেলভির হাতে দিয়ে চলে গেল। তাঁর দেবীর নিকটে নিবেদন করার ইচ্ছা এতদিনে তাঁর সার্থক হল। সেলভি কখনও নিষ্প্রয়োজনে কথা বলত না। সে সমগ্রদিন গভীর চিন্তায় ডুবে থাকত এবং নিজেকে গুটিয়ে রাখত। কেই-বা এল আর কেই-বা গেল সেদিকে তার ভূক্ষেপ থাকত না।
মোহন ভাবল নিশ্চয় সেলভিকে রাত্রিবেলায় একাকী পেতে পারে। একদিন রাত্রি এগারোটায় মার্কেট রোডে গাড়িটি রেখে বিনায়ক মুদালী স্ট্রীটে হেঁটে উপস্থিত হল। সে সেলভির ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে তাঁকে ডাকল, “প্রিয় সেলভি আমি এসেছি তোমার সাথে আমার জরুরী কথা আছে। দয়া করে দরজা খোল।” সেলভি দরজার ঘুলঘুলি খুলল এবং দৃঢ়স্বরে বলল, “চলে যাও, এই সময় এখানে আসার যথার্থ সময় নয়।” মোহনের গলায় যেন একদলা ঢিল জমে আছে সেরকম অনুভূতি নিয়ে বিযোদ্গার করল, “অকৃতজ্ঞ বদমাশ….।”