হবস, লক ও রুশো (Hobbes, Locke and Rousseau) তাঁদের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সামাজিক চুক্তি মতবাদের ব্যাখ্যা করেন। সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনার প্রভাব তাঁরা উপেক্ষা করতে পারেন নি। কিন্তু সেই ঘটনাবলীকে তিনজন দার্শনিক ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করেন। এর ফলে হবস, লক ও রুশোর মতবাদের মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়।
সাদৃশ্য: হবস, লক ও রুশোর মতবাদে যে সাদৃশ্যগুলি দেখা যায় সেগুলি হল—
- হবস, লক ও রুশো—তিনজন দার্শনিক কল্পনা করেছেন যে, রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বে আদিম মানুষ প্রাকৃতির রাজ্যে বাস করত। সেই পরিবেশে কোন শাসন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে নি এবং মানুষের সৃষ্ট কোন আইনকানুন ছিল না।
- ‘প্রাকৃতিক অবস্থায়’ অসহনীয় পরিবেশ থেকে মুক্তিলাভের জন্যে রাষ্ট্র গঠনের প্রয়োজন অনুভূত হয়।
- চুক্তির মাধ্যমে আদিম মানুষেরা রাষ্ট্রের পত্তন করে।
- স্বাধীনতা ও সম্পত্তির নিরাপত্তা এবং সুস্থ জীবনযাপনের উদ্দেশ্যেই আদিম মানুষ চুক্তিবদ্ধ হয়ে সরকার গঠন করে।
- হবস, লক ও রুশো তাঁদের মতবাদে শাসক ও শাসিতের সম্পর্কের স্বরূপ বিচার এবং সার্বভৌমিকতার স্বরূপ ব্যাখ্যা করেছেন।
বৈসাদৃশ্য: হবস, লক ও রুশোর মতবাদে যে বৈসাদৃশ্যগুলি দেখা যায় সেগুলি হল—
(১) প্রাকৃতিক পরিবেশ: প্রাকৃতিক অবস্থার অস্তিত্ব স্বীকার করলেও হবস, লক ও রুশোর প্রাকৃতিক অবস্থার চিত্র পরস্পর থেকে পৃথক। হবসের প্রাকৃতিক অবস্থায় নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা বিরাজ করত। মানুষের সৃষ্ট কোন আইন ছিল না। লকের মতে, প্রাকৃতিক অবস্থায় সুখ-শান্তি ও সাম্য বজায় ছিল। স্বাভাবিক আইনের নিয়ন্ত্রণে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারিত হত। কিন্তু স্বাভাবিক আইনের সুস্পষ্ট সংজ্ঞার অভাব, আইন ব্যাখ্যা ও আইনকে বলবৎ করবার জন্য উচ্চ মানবীয় কর্তৃপক্ষের অনুপস্থিতি অসুবিধার সৃষ্টি করে। রুশো বলেন, প্রাকৃতিক অবস্থায় স্বৰ্গীয় সুখ-শান্তি বিরাজ করত। আদিম মানুষ সাম্য, স্বাধীনতা ও মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে এক আদর্শ জীবন-যাপন করত। কিন্তু জনসংখ্যার বৃদ্ধি এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভবের ফলে মানুষে মানুষে বিরোধ ও সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠল।
(২) চুক্তি: হবসের মতে চুক্তি হয়েছিল একটি। আদিম মানুষ আত্মরক্ষার অধিকার ভিন্ন অন্য সকল অধিকার নিঃশর্তভাবে সমর্পণ করেছিল। রাজা নিজে চুক্তির ঊর্ধ্বে ছিলেন। তিনি চুক্তির কোনো পক্ষে ছিলেন না। লক দুটি চুক্তির উল্লেখ করেছেন—প্রথম চুক্তি আদিম মানুষেরা পরস্পরের সঙ্গে সম্পাদন করেছেন এবং দ্বিতীয় চুক্তিটি সম্পাদিত হয়েছিল যৌথভাবে আদিম মানুষের সঙ্গে শাসকের। লকের মতে, শাসক চুক্তির অন্যতম পক্ষ, সুতরাং চুক্তির শর্ত মেনে চলতে তিনি বাধ্য। রুশো হবসের ন্যায় একটি চুক্তির কথাই বলেছেন। রুশোর চুক্তিতে শাসককে চুক্তির অন্যতম পক্ষ বলে স্বীকার করা হয় নি।
(৩) সার্বভৌমের প্রকৃতি: হবস সার্বভৌম ক্ষমতা অসীম, অনিয়ন্ত্রিত ও চূড়ান্ত বলে মনে করেছেন। এই ক্ষমতার অধিকারী হলেন রাজা। সার্বভৌমের আদেশই আইন। সেই কারণে জনগণের সরকারের বিরোধিতা করবার কোন অধিকার নেই। লক্ মনে করতেন সরকার সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নয়। সার্বভৌমের ক্ষমতা জনগণের। লকের ন্যায় রুশোও বিশ্বাস করতেন সার্বভৌমিকতা জনগণের, সরকারের নয়।
(৪) সরকার: হবস ছিলেন চরম রাজতন্ত্রের সমর্থক। এজন্য তিনি সামাজিক চুক্তি মতবাদে রাজার হাতে চরম ক্ষমতা তুলে দিয়েছিলেন। এমনকি স্বৈরাচারী হলেও রাজার বিরুদ্ধে কোনো বিদ্রোহ ঘোষণা করা যাবে না বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেছিলেন। লক নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের কথা বলেছেন। রুশো প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রকে সমর্থন করেন। লক্ ও রুশো উভয়েই রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্টভাবে স্বীকার করেন। হবস রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে কোন পার্থক্য করেন নি।
(৫) ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও অধিকার: হবস চুক্তি মতবাদের ব্যাখ্যায় ব্যক্তির অধিকার অত্যন্ত সীমাবদ্ধ করে দেখেছেন। আত্মরক্ষার অধিকার ভিন্ন সকল অধিকার সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের নিকট নিঃশর্তে মানুষ সমৰ্পণ করেছিল। লক্ বলেন, মানুষ জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকার সমর্পণ করে নি। রুশো বলেছিলেন, আদিম মানুষ ‘সাধারণ ইচ্ছা’র নিয়ন্ত্রণে সকল অধিকার সমর্পণ করেছিল, কিন্তু ‘সাধারণ ইচ্ছা’-র অঙ্গ হিসাবে প্রত্যেকেই সেই স্বাধীনতা ফিরে পায়। সুতরাং চুক্তি সম্পাদন করেও মানুষ স্বাধীন রইল।
হবস, লক ও রুশো—তিনজন দার্শনিকের মতবাদ বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে, রুশো হবসের ধারণার সঙ্গে লকের বক্তব্যের সমন্বয় সাধন করে সামাজিক চুক্তির ব্যাখ্যা করেছিলেন।