খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতে কোনো কেন্দ্রীয় রাজশক্তি ছিল না। বৌদ্ধ ‘অঙ্গুত্তরনিকায়’ ও জৈন ‘ভগবতীসূত্র’ থেকে জানা যায় যে, এই সময় উত্তর ভারত ষোলোটি বৃহৎ রাজ্যে বিভক্ত ছিল এবং এদেরকে একত্রে বলা হত ‘ষোড়শ মহাজনপদ’ (Sixteen Mahajanapadas)। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের সূচনা থেকে মগধের উত্থান পর্যন্ত সময়কে ষোড়শ মহাজনপদের যুগ বলে অভিহিত করা হয়। ‘জন’ বলতে বোঝায় উপজাতি বা গোষ্ঠী। “জনপদ’ হল ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক এলাকা বা রাজ্য। ‘মহাজনপদ’ হল আরও শক্তিশালী ও বৃহত্তর আয়তযুক্ত রাজ্য। পাণিনির মতে, এই সময় উত্তর ভারতে ৩০টি জনপদ বা রাজ্য ছিল।
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে মূলত উত্তরপ্রদেশ ও বিহারকে কেন্দ্র করে মহাজনপদ গড়ে ওঠে। লোহার তৈরি শক্ত হাতিয়ার ও যন্ত্রপাতির সাহায্যে পাথুরে ও জঙ্গলাকীর্ণ জমিকে কৃষিকার্যের অধীনে আনা হয়। এর ফলে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। উদ্বৃত্ত খাদ্য উৎপাদনের ফলে নগরের বিকাশ ঘটে এবং রাজন্যবর্গ সৈন্য-সামন্ত ও কর্মচারীর সংখ্যা বৃদ্ধি করে বিশাল রাজ্য গঠনে তৎপর হন। এইভাবে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে বেশ কিছু শক্তিশালী রাজ্যের উদ্ভব ঘটে।(১) কাশী (Kasi) : ষোড়শ মহাজনপদ যুগের প্রথমদিকে কাশী ছিল সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ রাজ্য। কাশী রাজ্যের রাজধানী ছিল বারাণসী। বরুণা ও অসি নামে গঙ্গার দুই শাখানদী বারাণসী নগরটিকে বেষ্টন করে ছিল। ‘জাতক’ থেকে কোশল ও অঙ্গ রাজ্যের সঙ্গে কাশীর প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা জানা যায়। গৌতম বুদ্ধের সময় কাশী রাজ্যের পতন ঘটে এবং কোশল তা জয় করে।
(২) কোশল (Kosala) : বর্তমান উত্তরপ্রদেশের পূর্বাঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল কোশল। কোশল রাজ্যের রাজধানী ছিল শ্রাবন্তী। মহাভারত-খ্যাত বিখ্যাত ইক্ষ্বাকু বংশের মহাকোশল এখানে রাজত্ব করতেন। তিনি তাঁর কন্যা কোশলদেবীর সঙ্গে মগধ-রাজ বিম্বিসারের বিবাহ দেন। কোশল-রাজ প্রসেনজিৎ গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িক ছিলেন।
(৩) অঙ্গ (Anga) : বর্তমান বিহারের ভাগাপুর ও মুঙ্গের জেলা নিয়ে অঙ্গ রাজ্য গঠিত ছিল। অঙ্গ রাজ্যের রাজধানী ছিল চম্পা। গঙ্গা ও চম্পা নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত ছিল চম্পা নগরী। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ নামক গ্রন্থে অঙ্গ রাজ্যের সমৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। উত্তর ভারতে রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অঙ্গ রাজ্যের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল মগধ। শেষ পর্যন্ত মগধ-রাজ বিম্বিসার অঙ্গ রাজ্যটিকে গ্রাস করেন।
(৪) মগধ (Magadha) : বর্তমান বিহারের গয়া ও পাটনা জেলা নিয়ে মগধ রাজ্য গঠিত ছিল। গঙ্গা, শোন ও চম্পা নদী পরিবেষ্টিত মগধ রাজ্যের প্রথম রাজধানী ছিল গিরিব্রজ। পরবর্তীকালে মগধের রাজধানী স্থানান্তরিত হয় যথাক্রমে রাজগৃহ ও পাটলিপুত্র। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে বুদ্ধদেবের সমসাময়িক হর্যঙ্ক বংশীয় রাজা বিম্বিসার মগধের সিংহাসনে বসেন।
(৫) বৃজি (Vajji) : গঙ্গা নদীর উত্তর ভাগ থেকে নেপাল পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত ভূ-ভাগ নিয়ে বৃজি প্রজাতন্ত্র গঠিত ছিল। কানিংহাম (Cunningham)-এর মতে আটটি উপজাতি গোষ্ঠীর মানুষ যৌথভাবে বৃজি প্রজাতান্ত্রিক রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিল। এর মধ্যে শাক্য, লিচ্ছবি, জ্ঞাতৃক, বিদেহ ও বৃজি ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বৃজির অন্তর্গত শাক্য বংশে ভগবান বুদ্ধদেব এবং জ্ঞাতৃক কুলে মহাবীর জন্মগ্রহণ করেন। বৈশালী (বর্তমান মজঃফরপুর জেলা) ছিল বৃজি রাজ্যের রাজধানী।
(৬) মল্ল বা মালব (Malla) : বর্তমান উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর জেলায় মল্ল রাজ্য অবস্থিত ছিল। মল্ল ছিল একটি গণতান্ত্রিক রাজ্য। মল্ল রাজ্যটি দুই অংশে বিভক্ত ছিল এবং তাদের রাজধানী ছিল কুশীনগর ও পাবা। বুদ্ধদেব কুশীনগরে দেহরক্ষা করেন।
(৭) চেদি (Chedi) : যমুনা নদীর কাছে বর্তমান বুন্দেলখণ্ড ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল নিয়ে চেদি রাজ্যটি গঠিত ছিল। চেদি রাজ্যের রাজধানী ছিল শুকতিমতী (বর্তমান উত্তরপ্রদেশের বান্দা)। কাশী রাজ্যের সঙ্গে চেদিদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।
(৮) বৎস বা বংশ (Vatsa) : বর্তমান উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদের কাছে গঙ্গার দক্ষিণ তীরে বৎস রাজ্যটি অবস্থিত। বৎস রাজ্যের রাজধানী ছিল প্রাচীন কৌশাম্বী নগরী (বর্তমান কোশাম)। বৎস-রাজ উদয়ন প্রাচীন ভারতের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ছিলেন। মহাকবি ভাসের স্বপ্নবাসবদত্তা এবং শ্রীহর্ষের রত্নাবলী ও প্রিয়দর্শিকা — এই তিনটি নাটকের নায়ক হলেন উদয়ন। ইনি গৌতম বুদ্ধ, মগধ-রাজ বিম্বিসার ও অজাতশত্রুর সমসাময়িক ছিলেন। কথাসরিৎসাগর গ্রন্থে তাঁর দিগ্বিজয়ের বর্ণনা আছে।
(৯) কুরু (Kuru) : দিল্লি ও তার সন্নিহিত অঞ্চল নিয়ে কুরু রাজ্য গঠিত ছিল। কুরু রাজ্যের রাজধানী ছিল ইন্দ্রপ্রস্থ। মহাভারতের যুগে কুরু রাজ্যের রাজধানী ছিল ইন্দ্রগ্রহ। হস্তিনাপুর ছিল কুরু রাজ্যের অন্যতম প্রধান নগর।
(১০) পাঞ্চাল (Panchala) : বর্তমান রোহিলখণ্ড ও উত্তর প্রদেশের গঙ্গা-যমুনা দোয়াবের কিছু অংশ নিয়ে পাঞ্চাল রাজ্যটি গঠিত ছিল। জাতক, মহাভারত ও দিব্যবদান থেকে জানা যায় যে, গঙ্গা নদী পাঞ্চাল রাজ্যটিকে উত্তর পাঞ্চাল ও দক্ষিণ পাঞ্চাল নামে দুটি অংশে বিভক্ত করেছে। উত্তর পাঞ্চালের রাজধানী ছিল অহিচ্ছত্র এবং দক্ষিণ পাঞ্চালের রাজধানী ছিল কাম্পিল্য।
(১১) মৎস্য (Matsya) : বর্তমান রাজপুতানার জয়পুর, ভরতপুর ও আলোয়ার নিয়ে মৎস্য রাজ্য গঠিত ছিল। মহাভারতের খ্যাতিমান বিরাট রাজা মৎস্য রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। মৎস্য রাজ্যের রাজধানীর ছিল বিরাটনগর (বর্তমানের বৈরাট)।
(১২) শূরসেন (Surasena) : যমুনা নদীর তীরে শূরসেন রাজ্য অবস্থিত ছিল। শূরসেন রাজ্যের রাজধানী ছিল মথুরা। মহাভারত ও পুরাণ অনুসারে যদু বা যাদব-বংশীয় রাজারা এখানে রাজত্ব করত।
(১৩) অস্মক (Asmaka) : দক্ষিণ ভারতে গোদাবরী নদীর তীরে অবস্থিত অস্মক রাজ্যের রাজধানী ছিল পোটালি, পোটান বা পোদান। মহাভারতের বর্ণনা অনুসারে অস্মক নামে জনৈক রাজর্ষি পোদান নগরীর পত্তন করেন। বায়ুপুরাণে অস্মকের রাজাদের ইক্ষ্বাকু বংশীয় বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
(১৪) অবন্তী (Avanti) : মালব ও মধ্যপ্রদেশের কিছু অংশ নিয়ে অবন্তী রাজ্য গঠিত ছিল। বেত্রবতী নদী অবন্তী রাজ্যকে উত্তর ও দক্ষিণ দুভাগে ভাগ করেছিল। উত্তরাংশের রাজধানী ছিল উজ্জয়িনী এবং দক্ষিণাংশের রাজধানী ছিল মহিস্মতী (বর্তমান মাহেশ্বর)। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে গৌতম বুদ্ধের সময় এর অধিপতি ছিলেন প্রদ্যোৎ। তাঁকে চণ্ড প্রদ্যোৎ বলা হত।
(১৫) গান্ধার (Gandhara) : তক্ষশিলা (বর্তমান রাওয়ালপিণ্ডি) ও কাশ্মীর উপত্যকা নিয়ে গান্ধার রাজ্য গঠিত। ধৃতরাষ্ট্রের পত্নী গান্ধারী ছিলেন গান্ধার রাজ্যের রাজকন্যা। গান্ধার রাজ্যের রাজধানী ছিল তক্ষশিলা। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে পারসিক-রাজ গান্ধার রাজ্য জয় করেন।
(১৬) কম্বোজ (Kamboja) : উত্তর-পশ্চিম ভারতে গান্ধার রাজ্যের কাছে ছিল কম্বোজ রাজ্য। কম্বোজ রাজ্যের রাজধানী ছিল রাজপুর। আর্যরা ভারতে প্রবেশের সময়ে কম্বোজে বসবাস করে।
ষোড়শ মহাজনপদের অধিকাংশই ছিল বিহার, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্য ভারতে। আসাম, বঙ্গদেশ, উড়িষ্যা, গুজরাট, সিন্ধু এবং সুদূর দক্ষিণ অঞ্চলে কোনো আর্য মহাজনপদ ছিল না। দক্ষিণ ভারতে একটি মাত্র আর্য মহাজনপদ ছিল—অস্মক। সমগ্র পাঞ্জাবে মহাজনপদ ছিল দুটি—গান্ধার ও কুরু। মধ্য পাঞ্জাবে মহাজনপদ ছিল না। মহাজনপদগুলির মধ্যে বৃজি ও মল্ল ছিল গণরাজ্য। ষোড়শ মহাজনপদগুলির মধ্যে অবন্তী, বৎস, কোশল ও মগধ বেশ শক্তিশালী ছিল। আর্যাবর্তে প্রাধান্য স্থাপনের উদ্দেশ্যে তাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয় এবং শেষ পর্যন্ত মগধের সাফল্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার অবসান ঘটায়।
Q1. ষোড়শ মহাজনপদ যুগে ধর্মীয় অবস্থা কেমন ছিল?
ষোড়শ মহাজনপদ যুগে ধর্মীয় ক্ষেত্রে বহু জটিলতা লক্ষ্য করা যায়। উপাস্য দেবতাদের মধ্যে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরকে প্রাধান্য দেওয়া হত। যাগযজ্ঞ সর্বস্ব ধর্মানুষ্ঠান পরিচালনার জন্য সমাজে পুরোহিতরা প্রাধান্য লাভ করেছিল। এই যুগের অধিবাসীরা কর্মফল ও জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী ছিল। এই যুগে প্রধানত তিনটি চিন্তাধারা প্রাধান্য লাভ করেছিল— [ক] যাগযজ্ঞের উপরে অগাধ বিশ্বাস, যার মাধ্যমে যেকোন কাম্য বস্তু লাভ করা যেতে পারে, [খ] ব্রহ্মই চরম তত্ত্ব এবং আত্মাই একমাত্র নিত্য ও চরম সত্তা। উপনিষদের এই বাণীর প্রতি চরম আস্থা। [গ] সনাতন ও শাশ্বত নিয়মের প্রতি অবিশ্বাস।
Q2. ষোড়শ মহাজনপদ যুগের ব্যবসা-বাণিজ্য কেমন ছিল?
ষোড়শ মহাজনপদ যুগে বড়বড় বন্দর ও শহরকে কেন্দ্র করে ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে ওঠে। ভারুচ, ভৃঙ্গ, কচ্ছ, তাম্রলিপ্ত, সোপরা প্রভৃতি ছিল প্রধান বন্দর। আবার অন্তদেশীয় বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসাবে শ্রাবস্তী, তক্ষশিলা, কাশী, উজ্জয়িনী, অযোধ্যা, চম্পা প্রভৃতি নগরগুলি ছিল ব্যবসার কেন্দ্রস্থল। আবার ব্রহ্মদেশ, সিংহল, মালয়, ব্যাবিলন প্রভৃতি দেশের সঙ্গে ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্য চলত। ষোড়শ মহাজনপদ যুগে কর্সাপন নামক তামার ও রূপার মুদ্রার প্রচলন ছিল। তবে বড় বড় ব্যবসায়ীদের মধ্যে হুন্ডি প্রথার প্রচলন ছিল। এই সকল বাণিজ্য কেন্দ্র ছাড়া যে সকল গ্রামে শিল্প ও কারিগরী গড়ে উঠেছিল সেই সকল অঞ্চলকে কেন্দ্র করে নগর গড়ে উঠেছিল। নগরে আবার ছোটো ছোটো কারখানার উল্লেখ পাওয়া যায়।
Q3. ষোড়শ মহাজনপদ যুগের জাতিভেদ প্রথা কেমন ছিল?
ষোড়শ মহাজনপদ যুগে জাতিভেদ প্রথা তীব্র আকার ধারণ না করলেও তা ক্রমেই কঠোর থেকে কঠোরতর হয়ে উঠেছিল। স্বজাতির মধ্যে বিবাহ প্রচলিত থাকলেও বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে বিবাহ সম্বন্ধ স্থাপনের কোন বাধা ছিল না। অসবর্ণ বিবাহ একেবারে নিষিদ্ধ হয়েছিল এবং তা শাস্ত্র বিরুদ্ধ ছিল। এই জাতিভেদ প্রথাকে কেন্দ্র করেই উচ্চশ্রেণি ও নিম্নশ্রেণির মধ্যে সংঘর্ষের সূচনা হয়েছিল। এই যুগে ব্রাহ্মণদের প্রাধান্য কতকটা স্বৈরচারিতায় পরিণত হয়েছিল।
Q4. ষোড়শ মহাজনপদ যুগের দাসত্ব প্রথা কেমন ছিল ?
ষোড়শ মহাজনপদ যুগে দাসত্ব প্রথার প্রচলন ছিল। যুদ্ধবন্দী বা দন্ডিত অপরাধীদের দাসে পরিণত করা হত। জন্মসূত্রে অনেকে দাস হত, এবং তারা সম্পত্তির অধিকারী হতে পারত না। অর্থের বিনিময়ে অনেক দাসকে মুক্তি দেওয়া হত।
Q5. ষোড়শ মহাজনপদ যুগের কৃষিকাজ কেমন ছিল?
ষোড়শ মহাজনপদ যুগের জনসাধারণের প্রধান জীবিকা ছিল কৃষি, ধানের চাষ প্রধান হলেও বাদাম ফল, শাকসবজিও চাষ হত। সমবায় ভিত্তিতে সেচের জন্য খাল খনন করা হত এবং বিশেষ বিশেষ স্থানে জলাধার নির্মাণ করে জলসায়ের ব্যবস্থা করা হত। কৃষি জমি গ্রামের লোকের মধ্যে ভাগ করা হত এবং ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃত ছিল। গবাদি পশুর জন্য পশুচারণ ভূমি ছিল। উৎপন্ন ফসলের ১/৬ অংশ বা ১/১০ অংশ খাজনা হিসাবে ধার্য্য করা হত।
Q6. ষোড়শ মহাজনপদ যুগের পোশাক পরিচ্ছদ কেমন ছিল?
পুরুষের পোশাক প্রধানত তিনটি অংশে বিভক্ত ছিল। যথা— শিরাভবন, নীবি ও অধিবাস। পুরুষেরা দাঁড়ি রাখতেন এবং গহণা পরতেন। সম্ভ্রান্ত মহিলারা হার, বলয়, তাগা, বাজু প্রভৃতি নানান স্বর্ণ ও রৌপোর অলংকার ব্যবহার করতেন।
Q7. ষোড়শ মহাজনপদের যুগে রাজপরিবারের জীবন ধারণ কেমন ছিল ?
রাজন্য এবং অভিজাতগণের জীবনযাত্রার প্রণালী ছিল খুবই উন্নতমানের। উচ্চবিত্ত সম্প্রদায়ের কন্যাগণ কুন্দুক নামক একপ্রকার বল খেলতে ভালবাসতেন। যুব সম্প্রদায় কুন্দুক এবং ভিটা খেলতেন। এছাড়া শিকার দ্রুত ক্রীড়া, অস্ত্র খেলা, যুদ্ধের কাহিনী শ্রবণ, অস্ত্রচালনা, নৃত্যগীত প্রভৃতি আমোদ প্রমোদ এই সময়ে প্রচলিত ছিল।
Q8. ষোড়শ মহাজনপদ যুগের শহরের জীবন কেমন ছিল ?
প্রাচীর বেষ্টিত সুরক্ষিত শহরে বাস করতেন কেবলমাত্র রাজাগণ, রাজকর্মচারীগণ, সভাসদগণ। উচ্চ রক্ষীস্তম্ভ থাকত শহরের প্রাচীরের নানাস্থানে। এই ব্যবস্থা বাইরের নিরাপত্তার জন্য কেবলমাত্র অবলম্বন করা হয়েছিল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছিল কাষ্ঠ নির্মিত রাজপ্রাসাদ। প্রশস্ত রাস্তাঘাট, প্রমোদ উদ্যান, বিচারভবন, ক্রীড়াভবন, নিত্যশালা প্রভৃতি শহরের মধ্যেই থাকত।
Q9. ষোড়শ মহাজনপদ যুগে নারীদের অবস্থা কেমন ছিল?
ষোড়শ মহাজনপদ যুগে নারীরা সম্মানীয়া হলেও পূর্বের তুলনায় নারীদের মর্যাদা অনেক হ্রাস পেয়েছিল। অনেক ক্ষেত্রে নারীদেরকে শুধুমাত্র ভোগ্য বস্তু হিসাবেই গ্রহণ করা হত। এমনকি পাশা খেলা, জুয়া খেলায় তাদেরকে যৌতুক রূপে রাখা হত। এই যুগে নারীরা পুরুষের ন্যায় একাধিক স্বামী গ্রহণ করতে পারত। এই সময় কোন কোন ক্ষেত্রে নারীরা নিজের ইচ্ছামত স্বামী নির্বাচন করত এবং স্বয়ম্বর প্রথারও প্রচলন ছিল। ভারতের উত্তর পশ্চিম অংশে আবার সতীদাহও প্রচলিত ছিল।
Q10. ষোড়শ মহাজনপদ যুগের সমিতির ক্ষমতা কেমন ছিল?
ষোড়শ মহাজনপদ যুগে জনসাধারণের সভার নাম ছিল সমিতি। ব্রাহ্মণ শ্রেণি মন্ত্রীসভা ছাড়াও রাজাকে সমিতির মতামত গ্রহণ করতে হত। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এই সমিতির মূল্য ছিল অত্যাধিক। জনসাধারণের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত এই সমিতির মতামত ভিন্ন রাজকার্য পরিচালনা বা কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা রাজার ছিল। না। বিশেষ ক্ষেত্রে অত্যাচারী রাজাকে সিংহাসনচ্যুত এমনকি প্রাণদণ্ডে দন্ডিত করার অধিকারও ছিল এই সমিতির। তারও প্রমাণ পাওয়া গেছে।
Q11. ষোড়শ মহাজনপদ যুগের ব্রাহ্মণদের প্রাধান্য কেমন ছিল?
ষোড়শ মহাজনপদ যুগে রাজার ক্ষমতা অসীম এবং স্বৈরতান্ত্রিক হলেও প্রকৃতপক্ষে ব্রাহ্মণ শ্রেণি, মন্ত্রীবর্গ, রাজসভা ও গ্রামবাসীদের মতামত ভিন্ন রাজাগণ শাসনকার্য সম্পন্ন করতে পারতেন না। প্রকাশ্য সভায় রাজাকে সিংহাসন হতে অবতরণ করে ব্রাহ্মণগণকে প্রণাম করতে হত। এই সময়ে ব্রাহ্মণগণ বিদ্যা ও কৃষ্টির মূর্ত প্রতীক বলে বিবেচিত হতেন। আবার যুদ্ধের সময় ব্রাহ্মণগণ রাজার জয়লাভের জন্য পূজা অর্চনা করে রাজাকে আশীর্বাদ করতেন। এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয়ে ব্রাহ্মণেরা রাজার প্রধান পরামর্শদাতার ভূমিকা পালন করতেন।
Q12. ষোড়শ মহাজনপদ যুগে সামাজিক অবস্থা কেমন ছিল?
ষোড়শ মহাজনপদ যুগে একান্তবর্তী পরিবার ছিল। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়গণ ছিলেন সমাজের সবচেয়ে সুবিধাভোগী শ্রেণি। তাদের কোন কর দিতে হত না। ষোড়শ মহাজনপদ যুগে জনসাধারণ পল্লীবাসী ছিল। কেবল রাজা ও রাজকর্মচারীরাই সুরক্ষিত নগরে বাস করতেন। ষোড়শ মহাজনপদ যুগে জাতিভেদ প্রথা ক্রমেই কঠোর হতে থাকে এবং উচ্চশ্রেণি ও নিম্ন শ্রেণির মধ্যে সংঘর্ষ বৃদ্ধি পায়। সমাজে দাসত্ব প্রথা প্রচলন ছিল। অসবর্ণ বিবাহ শাস্ত্র বিরুদ্ধ ছিল। ব্রাহ্মণদের স্বৈরচারিতা ষোড়শ মহাজনপদ যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল।
Q13. ষোড়শ মহাজনপদ যুগে গণতন্ত্র সম্পর্কে কী জানা যায়?
গণতন্ত্র বা প্রজাতন্ত্র শাসিত রাষ্ট্রের শাসন ও বিচার সম্পর্কিত সকল কার্য গোষ্ঠীর সমিতির দ্বারা নির্বাহ হত। এই সমিতিকে সংস্থাগার বলা হত। প্রত্যেক নাগরিক এই সংস্থাগারের সদস্য হত কিনা সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। গোষ্ঠীর প্রধান ব্যক্তিরা রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন। এবং তাদেরকে গণ্যমুখ বা প্রধান বলা হত। প্রতি গ্রামে ও নগরে জনসাধারণ কর্তৃক নির্বাচিত এইরূপ সংস্থাগার ছিল। প্রজাতান্ত্রিক শাসিত রাষ্ট্রের কোন কোন রাষ্ট্র পরিচালক ‘রাজা’ উপাধি গ্রহণ করতেন। এইরূপ প্রমাণ আছে যেমন— কপিলাবস্তু।
Q14. ষোড়শ মহাজনপদ যুগের রাজতন্ত্র সম্পর্কে কী জানা যায় ?
ষোড়শ মহাজনপদ যুগের অনেক রাজাই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন। আবার রাজাদের মধ্যে সম্রাট, একরাট, একরায় প্রভৃতি উপাধিধারী রাজাও দেখা যায়। রাজপদ বংশগত ছিল। রাজা নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হলেও স্বেচ্ছাচারী হতেন না। অনেক সময়ে তারা প্রতিনিধি সভার পরামর্শক্রমে রাজ্যশাসন করতেন। ষোড়শ মহাজনপদ যুগে রাজ্য বা সাম্রাজ্য উভয় প্রকার রাষ্ট্রের ও রাষ্ট্র পরিচালকদের বিভিন্ন উপাধির উল্লেখ পাওয়া যায়। যে রাজা রাজসূয় যজ্ঞ করতেন তাকে রাজন বলা হত এবং যিনি রাজজ্ঞেয় অশ্বমেধ যজ্ঞ করতেন তাকে সম্রাট বা একরাট বলা হত। সার্বভৌম ক্ষমতা ও একচ্ছত্র আধিপত্য স্থাপন করার প্রচেষ্টা ষোড়শ মহাজনপদ যুগে বিশেষ লক্ষ্যনীয়। শাস্ত্রগত বিধান লঙ্ঘন করার ক্ষমতা রাজার ছিল না।
Q15. ষোড়শ মহাজনপদের রাজনৈতিক সংগঠনের প্রকৃতি কেমন ছিল?
ষোড়শ মহাজনপদের রাজনৈতিক সংগঠনে যেমন ছিল রাজতন্ত্র, তেমনি ছিল গণরাজ্য। রাজতন্ত্রগুলোতে রাজাই ছিল নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী। আর গণরাজ্য সমূহে গ্রাম ও শহরের প্রধানরা মিলিত হয়ে একজন অধ্যক্ষ নির্বাচিত করতেন। এই অধ্যক্ষের অধিকার কেবল তার জীবদ্দশা পর্যন্ত বলবৎ থাকত। রাজতন্ত্রতে কিছু রাজা বংশানুক্রমিকভাবে অধিকার ভোগ করতেন। অঙ্গ, মগধ প্রভৃতি ছিল রাজতান্ত্রিক আর বৃজি, মল্ল প্রভৃতি ছিল গণরাজ্য।
Q16. ষোড়শ মহাজনপদ যুগে স্বায়ত্তশাসিত উপজাতিক রাজ্যগুলি কী কী?
ষোলটি রাজ্য ছাড়াও মহজনপদ যুগে কয়েকটি স্বায়ত্তশাসিত উপজাতির উল্লেখ পালি গ্রন্থে ও মেগাস্থিনিসের বিবরণে পাওয়া যায়। এইগুলি হল কপিলাবস্তুর শাক্য জাতি, রামগ্রামের কৌলিয় জাতি, পিপ্পলিবনের মৌরেয় জাতি, আল্লকপপার বুলি জাতি, সুমসুমার গিরির ভগ্য জাতি, কেশপুত্তর কালামা জাতি, বৈশালীর লিচ্ছবি জাতি, মিথিলার বিধেয় জাতি প্রভৃতি। এদের মধ্যে কয়েকটি ছিল স্বাধীন এবং কয়েকটি ছিল আংশিক স্বাধীন। এই রাষ্ট্রগুলি হিমালয়ের পাদদেশ থেকে গঙ্গানদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
Q17. ষোড়শ মহাজনপদ যুগের কয়েকটি প্রজাতান্ত্রিক রাজ্যের নাম উল্লেখ করুন।
লিচ্ছবি, বৃজি, মল্ল, ভোগ, কৌরব, ইক্ষাকু প্রভৃতি জাতিগুলি ছিল প্রজাতান্ত্রি শাসনাধীনে।