ডোমিনগোস পায়েজ, ফার্নাও নুনিজ, নিকোলো কন্টি, আবদুর রজ্জাক, এডওয়ার্ড বারবোসা প্রমুখ বিদেশি পর্যটকদের বিবরণ থেকে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সামাজিক অবস্থার বিস্তারিত তথ্যাদি জানা যায়।
সমাজে চতুর্বর্ণ প্রথা যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। জাতিভেদ-প্রথার ভিত্তিতে গড়ে-ওঠা সমাজ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখাই ছিল রাজার অন্যতম কর্তব্য। প্রখ্যাত কবি পেড্ডান রচিত ‘মনুচরিত্রম’ গ্রন্থে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদের যথাক্রমে বিশ্রুলু, রাজুলু, মোতিকিরাতল এবং নলভজতিভারু বলে অভিহিত করা হয়েছে। সমাজে ব্রাহ্মণদের সর্বাধিক সম্মান ছিল। বিজয়নগরের রাজারা ব্রাহ্মণদের বিশেষ মর্যাদা দিতেন। ফলে সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনে ব্রাহ্মণদের বিশেষ কর্তৃত্ব তো ছিলই; ক্রমে রাজনীতিতেও তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছিল। সমাজ, রাষ্ট্র ও ধর্মীয় জীবনে তাঁদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। বেদের বিখ্যাত টীকাকার সায়ন দ্বিতীয় হরিহরের মন্ত্রী ছিলেন। ব্রাহ্মণরা নিরামিষভোজী হলেও, সাধারণ মানুষ মাংস ভক্ষণ করত। সমাজে গোমাংস নিষিদ্ধ ছিল। কৃষ্ণদেব রায় ও অচ্যুত রায় গোঁড়া হিন্দু ও বিষ্ণুর উপাসক হয়েও পশু-পক্ষীর মাংস ভক্ষণ করতেন। নুনিজ লিখেছেনঃ “বাজারে অবাধে পশু-পাখির মাংস কেটে বিক্রি করা হত।” সমাজে সব শ্রেণির মধ্যে অবাধ মেলামেশা চলত।
সমাজ, রাজনীতি, সামরিক ও সাংস্কৃতিক ব্যাপারে নারীরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করতেন। তাঁরা কারুশিল্প, চারুশিল্প, নৃত্য, সংগীত, সাহিত্য, কলাবিদ্যা ও শাস্ত্রচর্চা করতেন। মল্লক্রীড়া ও অসিঁচালনাতেও তাঁরা পারদর্শিনী ছিলেন। পর্তুগিজ নুনিজ লিখেছেন যে, এখানে কোনও কোনও নারী প্রহরী, বিচারক (জ্যোতিষী) ও হিসাবরক্ষকের কাজ করতেন। গঙ্গাদেবী, হোনাম্মা ও তিরুমালাম্মা ছিলেন সে যুগের বিখ্যাত কবি। পুরুষের বহুবিবাহ, পণপ্রথা, বাল্যবিবাহ, সতী ও দেবদাসী প্রথা নারীর মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে। বিদেশি পর্যটকদের রচনা থেকে দেবরায়, কৃষ্ণদেব রায়, অচ্যুত রায় প্রমুখ রাজন্যবর্গের বহু পত্নীর অস্তিত্বের কথা জানা যায়। বিদেশী পর্যটকরা রাজাদের অসংখ্য পত্নী দেখে বিস্মিত হয়েছেন। নিকোলো কন্টি লিখেছেন, “দেব রায়ের বারো হাজার পত্নী ছিলেন।” নুনিজ লিখেছেন, “রাজা অচ্যুত রায়ের পত্নীর সংখ্যা ছিল পাঁচশত”। পায়েজের বিবরণ থেকে জানা যায়, “রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের আইনসম্মত বারোজন রানী ছিলেন, তার মধ্যে মাত্র তিনজন রানীর সন্তান সিংহাসনের দাবিদার হতে পারত।” সমাজে দেবদাসী প্রথা প্রচলিত ছিল।
বিজয়নগরের নৃপতিগণ বিষ্ণুর উপাসক হলেও সকল ধর্মের প্রতি তাঁরা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। বিজয়নগরের রাজা ও অ-ব্রাহ্মণদের খাদ্যতালিকা দেখে ড. ভি. স্মিথ বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। হিন্দুত্ববাদের রক্ষক এবং বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী শাসক ও সাধারণ মানুষের এত বেশি মাংসভোজী হওয়ার কথা এবং প্রাণীহত্যার ঘটনা তাঁর কাছে কিছুটা অবাস্তব মনে হয়েছে। বিজয়নগরে বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টান, ইহুদি, মুসলিম—সকল ধর্মের মানুষই নির্বিবাদে বসবাস করত। শাসন ব্যবস্থাতেও তাঁরা ধর্মনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করেন।