পাল ও সেন যুগের সামাজিক জীবন সম্পর্কে জানার জন্য সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত ‘রামচরিত’ একটি মূল্যবান গ্রন্থ। ভবদেব ভট্ট, জীমূতবাহন, শূলপাণি ও রঘুনন্দন রচিত স্মৃতিগ্রন্থাদি, বৃহদ্ধর্ম পুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, বল্লাল চরিত, হলায়ুধের ব্রাহ্মণসর্বস্ব প্রভৃতি গ্রন্থাদি এবং বিভিন্ন লেখ ও তাম্রপট্ট থেকে পাল ও সেন যুগের সমাজ জীবন সম্পর্কে প্রচুর তথ্যাদি পাওয়া যায়।
বর্ণ ব্যবস্থা (Caste System)
পাল আমলে বাংলায় আর্যদের চতুর্বর্ণের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। সমাজের শীর্ষে ছিলেন ব্রাহ্মণরা। পাল যুগে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য বর্ণের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। পাল রাজারা উচ্চবংশজাত ছিলেন বলে মনে হয় না। পাল যুগের বৌদ্ধরা মনুর অনুশাসন মেনে চলত। পাল যুগে ব্রাহ্মণ ও বৌদ্ধদের মধ্যে সমন্বয় গড়ে ওঠে। সমাজে ব্রাহ্মণদের পরেই পদস্থ সরকারি কর্মচারী করণ-কায়স্থদের স্থান ছিল। পাল যুগে একশ্রেণির চিকিৎসক ‘বৈদ্য’ নামে এক বিশেষ উপবর্ণ গড়ে তোলেন। পাল যুগে প্রথম কৈবর্তদের উল্লেখ পাওয়া যায়। কৈবর্তরা যে বিশেষ শক্তিশালী গোষ্ঠী ছিল, তাঁরা প্রমাণ পাওয়া যায় দিব্যর বিদ্রোহ ও সাফল্য থেকে। সমাজের নিম্নতর স্তরে চণ্ডাল, মেদ, শবর, ডোম, অন্ধ্র, কাপালি প্রভৃতি বর্ণের উল্লেখ পাওয়া যায়।
সেন যুগে বর্ণ ব্যবস্থা কঠোর ও অনমনীয় রূপ ধারণ করে। ভবদেব ভট্ট, জীমূতবাহন, শূলপাণি, রঘুনন্দন, অনিরুদ্ধ ভট্ট, হলায়ুধ প্রমুখ শাস্ত্রকাররা নতুন সামাজিক রীতি-নীতি প্রবর্তনে উদ্যোগী হন। সমাজে ব্রাহ্মণরা সর্বোচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত ছিল। সেন যুগে ভৌগোলিক অবস্থানের ভিত্তিতে ব্রাক্ষ্মণদের রাঢ়ীয়, বরেন্দ্রী, বৈদিক, কুলীন, ভঙ্গ কুলীন, অভঙ্গ কুলীন প্রভূতি ভাগে বিভক্ত করা হয়। বাংলায় কৌলিন্য প্রথা প্রবর্তনের সঙ্গে বল্লাল সেনের নাম জড়িত আছে। এই যুগে ব্রাহ্মণরা গ্রামের নাম অনুযায়ী পদবি গ্রহণ করত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, চট্টগ্রামের উপাধ্যায় চট্টোপাধ্যায়, ভট্ট গ্রামের আচার্য ভট্টাচার্য নামে পরিচিত ছিলেন। সেন যুগে ব্রাহ্মণ ছাড়া সমস্ত বর্ণকে সংকর ও শূদ্র বর্ণের অন্তর্গত বলে মনে করা হত। এঁদের উত্তম সংকর, মধ্যম সংকর ও অধম সংকর বা অন্ত্যজ—এই তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করে প্রতিটি উপবর্ণের মর্যাদা ও বৃত্তি নির্দিষ্ট করা হত।
খাদ্য, পোশাক, অলঙ্কার (Food, Clothes, Ornaments)
বাঙালির প্রধান খাদ্য ছিল ভাত, ডাল, মাছ, মাংস, শাক-সবজি, দুধ ও দুগ্ধজাত সামগ্রী, গুড় প্রভৃতি। ব্রাহ্মণ ছাড়া সব সম্প্রদায়ের মধ্যে মদ্যপান প্রচলিত ছিল। উৎসবে পিঠে-পায়েসের প্রচলন ছিল। পোশাক হিসেবে পুরুষরা ধুতি এবং মেয়েরা শাড়ি ব্যবহার করত। পুরুষদের ধুতি সাধারণত হাঁটুর নীচে নামত না, যদিও শাড়ি পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত পৌঁছত। ক্ষেত্রবিশেষে পুরুষরা উত্তরীয় এবং মেয়েরা ওড়না ও চোলি ব্যবহার করত। পাল ও সেন যুগে চামড়া ও কাঠের জুতোর খড়ম প্রচলন ছিল। নারী-পুরষ উভয়ের মাথাতেই থাকত লম্বা কুঞ্চিত কেশদাম। পুরুষের চুল বাবরির মতো কাঁধ পর্যন্ত ঝুলত। মেয়েরা নানা ধরনের খোঁপা বাঁধত। সধবা মেয়েরা কাজলের টিপ, সিঁদুর, আলতা, কুমকুম ও নানা গন্ধদ্রব্য ব্যবহার করত। পুরুষ ও মহিলা উভয়েই সোনা, রুপো, হিরে ও মুক্তোর অলঙ্কার ব্যবহার করত।
উৎসব, বিনোদন, যানবাহন (Festivals, Entertainment, Vehicles)
বাঙালি সমাজে পূজা-পার্বণ ও উৎসবের শেষ ছিল না। দুর্গা, কালী, জগদ্ধাত্রী ও লক্ষ্মীপূজা, দোল, ভ্রাতৃদ্বিতীয়া, জন্মাষ্টমী, দশহরা, চৈত্র-সংক্রান্তি—এইসব বারো মাসে তেরো পার্বণ বাঙালি সমাজে প্রচলিত ছিল। বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে সমাজে নানা ক্রীড়া-কৌতুক প্রচলিত ছিল। পাশা ও দাবাখেলা, নৃত্য-গীত, অভিনয় প্রভৃতির খুব চল ছিল। এই যুগে বীণা, বাঁশি, মৃদঙ্গ, করতাল, ঢাক, ঢোল প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের প্রচলন ছিল। পুরুষরা শিকার, মল্লযুদ্ধ, লাঠিখেলা, নৌকা বাইচ প্রভৃতিতে অংশ নিত। মেয়েরা উদ্যান রচনা ও জলক্রীড়া পছন্দ করত। যানবাহন হিসেবে গরুর গাড়ি ও নৌকা ব্যবহৃত হত। ধনীরা হাতি, ঘোড়া ও ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করত।
নারীর অবস্থান (Position of Women)
পাল ও সেন যুগে বাঙালি সমাজে নারী মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। ব্যাৎসায়ন তাঁর ‘কামসূত্রে’ গৌড়বঙ্গের রমণীদের মৃদুভাষিণী, কোমলাঙ্গী, অনুরাগবর্তী, শান্ত ও সুন্দরী বলে বর্ণনা করেছেন। সমাজে উচ্চশ্রেণীর নারীদের মধ্যে পর্দাপ্রথা প্রচলিত ছিল। এই যুগে মেয়েরা লেখাপড়া শিখত। কৌলিন্য প্রথার সুযোগ নিয়ে কুলীন পুরুষরা একাধিক বিবাহ করত। যৌতুক প্রথা, সতী ও সহমরণ প্রচলিত ছিল। বৈধব্য ছিল অভিশাপ। বিধবাদের কঠোর সংযম ও কৃচ্ছসাধনার মধ্যে জীবন কাটাতে হত। পুত্রহীনা বিধবারা স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী ছিলেন। সতীদাহ প্রথা প্রচলন ছিল।