বর্তমানে আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন এবং মানব অধিকার সম্পর্কিত সর্বজনীন ঘোষণার ফলে সামাজিক অধিকারের গুরুত্ব স্বীকার করা হয়েছে। ব্যক্তিত্বের পূর্ণাঙ্গ বিকাশের জন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের বিশেষ প্রয়োজন। সামাজিক শোষণ-বঞ্চনা অসাম্যের বিরুদ্ধে অধিকার স্বীকৃত না হলে গণতান্ত্রিক আদর্শ সার্থক হয় না, ব্যক্তি-জীবনের সর্বাঙ্গীণ বিকাশও হতে পারে না। সে কারণে বর্তমানের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কতকগুলি অধিকার সামাজিক অধিকার হিসাবে মর্যাদা ও গুরুত্ব লাভ করেছে।
(১) শিক্ষা ও সংস্কৃতির অধিকার (Right to education and culture): ব্যক্তি-জীবনের অন্তর্নিহিত গুণাবলীর উপযুক্ত বিকাশে শিক্ষার মূল্য অপরিসীম। উপযুক্ত শিক্ষাপ্রাপ্ত নাগরিক যথার্থভাবে আপন দায়িত্ব পালন করতে পারে। শিক্ষা ছাড়া মানুষ আপনাকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারে না। বর্তমান সমাজ-জীবনে শিক্ষিত অশিক্ষিতের ব্যবধান কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সে কারণে পৃথিবীর সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য সামাজিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃত। মানবাধিকার সম্পর্কিত সর্বজনীন ঘোষণায় প্রত্যেক মানুষের শিক্ষার অধিকারের গুরুত্ব স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ, মানব অধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবার জন্যই শিক্ষার প্রয়োজন। শিক্ষা নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও যোগ্যতানুযায়ী সকলের সমান সুযোগ থাকাও কাম্য। শিক্ষার অধিকারের সঙ্গে সংস্কৃতির অধিকার ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব জাতীয় সাংস্কৃতিক জীবনে অংশগ্রহণ করে শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান-বিষয়ক বিভিন্ন কীর্তির সংরক্ষণের মাধ্যমে জাতীয় কৃষ্টির প্রসার সাধনের সমান অধিকার রয়েছে। প্রতি মানুষের নিজস্ব ভাষা ও কৃষ্টি সংরক্ষণের অধিকারও স্বীকার করা উচিত।
(২) স্বাস্থ্য সংরক্ষণের অধিকার (Right to protection of health): সুস্থ সবল নাগরিকই জাতির সম্পদ। জাতীয় কল্যাণ ও সমৃদ্ধির প্রসারে সুস্থদেহী নাগরিকই নতুন নতুন কর্মে উৎসাহ উদ্দীপনার সঞ্চার করতে পারে। সুতরাং স্বাস্থ্য সংরক্ষণ নাগরিকের গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। সুস্থ পরিচ্ছন্ন সামাজিক পরিবেশই সুন্দর জীবন সম্ভব করতে পারে, দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক গড়ে তুলতে পারে। সুতরাং স্বাস্থ্যকর পরিবেশ গঠন, রোগ- মহামারী প্রতিরোধের উপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন, সহজ ও সুলভ চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রভৃতির মাধ্যমে নাগরিকের এই অধিকার নিশ্চিত হতে পারে।
(৩) সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার (Right to social security): সমাজের এক সভ্য হিসাবে প্রত্যেক মানুষের বিশেষ অবস্থায় নিরাপত্তার সুযোগ থাকা একান্তই কাম্য। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার মধ্যেও সকল দেশের নাগরিকের সামাজিক নিরাপত্তার অধিকারের কথা বলা হয়েছে। বার্ধক্যে মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে, বৈধব্যের জন্য নারী অন্নবস্ত্রের অভাবে বিব্রত হয়, অকর্মণ্য বা বেকার হলে মানুষ সহায়সম্বলহীন বোধ করে। এই সকল অবস্থায় মানুষের ভরণপোষণের অধিকার থাকা উচিত বলে বর্তমানে স্বীকার করা হয়েছে। সামাজিক বীমা, সরকারী সাহায্য, বৈধব্য ভাতা প্রভৃতির মাধ্যমে এই অসহায় অবস্থা দূরীকরণের জন্য রাষ্ট্রকে উদ্যোগী হতে হবে।
(৪) শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার (Right against exploitation): দাসত্ব প্রথা বর্তমান সভ্য দুনিয়ায় বিলুপ্ত হলেও শোষণ-বঞ্চনার অভিশাপ হতে মানুষ সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পারে নি। শ্রমিক, দরিদ্র কৃষক, অসহায় নারী ও শিশুর ওপর অন্যায়-অত্যাচারের ঘটনা বর্তমান সমাজেও নিতান্ত কম নয়। এই শোষণ-বঞ্চনার নিত্য- নতুন কলাকৌশলের কবল হতে মুক্তির অধিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রত্যেক নাগরিকের ন্যায়সঙ্গত সামাজিক অধিকার। সমাজের দুর্বল শ্রেণীকে শোষণের হাত থেকে রক্ষা করবার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে গ্রহণ করতে হবে।