গুপ্ত যুগের ইতিহাস রচনার জন্য উপাদানের কোনো অভাব নেই। গুপ্ত যুগের ইতিহাস রচনার উপাদানগুলিকে—(১) সাহিত্য, (২) শিলালিপি, (৩) মুদ্রা এবং (৪) স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও শিল্প প্রভূতি ভাগে ভাগ করা যায়। এই উপাদানগুলি সম্মিলিতভাবে গুপ্ত সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং শাসন ব্যবস্থার বিস্তৃত চিত্র প্রদান করে।
সাহিত্য উপাদান (Literary Sources)
সাহিত্য উপাদানের মধ্যে প্রথমে পুরাণের কথা বলা যায়। এ সম্পর্কে বায়ুপুরাণ, মৎস্যপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ, ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ ও ভাগবতপুরাণ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এগুলি থেকে গুপ্ত রাজাদের নাম, সাম্রাজ্যের আয়তন ও বিভিন্ন প্রদেশগুলির বিবরণ পাওয়া যায়। এছাড়া বিভিন্ন স্মৃতিশাস্ত্র—বিশেষত নারদ স্মৃতি ও বৃহস্পতি-স্মৃতি নানা তথ্য সরবরাহ করে।
সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রী শিখর রচিত কামন্দক-নীতিসার গ্রন্থ থেকে গুপ্ত যুগের রাষ্ট্রবিজ্ঞান, রাষ্ট্রাদর্শ ও শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে নানা তথ্য জানা যায়।
গুপ্ত যুগে রচিত কিছু নাটক থেকে ইতিহাসের তথ্যাদি পাওয়া যায়। বজ্জিকা নামক জনৈক বিদুষী মহিলা রচিত ‘কৌমুদি-মহোৎসব’ এবং ভাস, শূদ্রক, কালিদাস, বিশাখদত্ত ও ভারবি রচিত নাটকগুলি ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এ সম্পর্কে ভাস রচিত স্বপ্নবাসবদত্তা ও চারুদত্ত, কালিদাস রচিত অভিজ্ঞানশকুন্তলম, শুদ্রকের মৃচ্ছকটিক, বিশাখদত্তের দেবীচন্দ্রগুপ্তম ও মুদ্রারাক্ষস এবং ভারবির কিরাতার্জুনীয়ম নাটকের কথা বলা যায়।
বিদেশি পর্যটক ফা-হিয়েন, হিউয়েন সাং ও ইৎ-সিং প্রভূতি পর্যটকদের ভ্রমণবৃত্তান্ত গুপ্ত যুগের ইতিহাস রচনায় নানাভাবে সাহায্য করে। তাঁদের লেখা থেকে সেই সময়ের সামাজিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক অবস্থার প্রাণবন্ত বর্ণনা পাওয়া যায়।
শিলালিপি (Inscriptions)
গুপ্ত যুগের প্রায় ৪২টি লিপি পাওয়া গেছে, যা গুপ্ত যুগের ইতিহাস রচনায় প্রভৃত সাহায্য করে। সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি হরিষেণ রচিত এলাহাবাদ প্রশস্তি থেকে সমুদ্রগুপ্তের রাজ্যজয় ও বৈদেশিক সম্পর্ক সম্বন্ধে নানা তথ্য পাওয়া যায়। এরাণ, নালন্দা ও গয়া লিপি থেকেও সমুদ্রগুপ্ত সম্পর্কে খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগৃহীত হয়েছে। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের উদয়গিরি গুহালিপি, মথুরা লিপি, সাঁচি লিপি, মেহেরৌলি লিপি খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম কুমারগুপ্তের রাজত্বকাল সম্পর্কে দামোদরপুর লিপি এবং মান্দাশোর লিপি যথেষ্ট সহায়ক। এ ছাড়াও জুনাগড় লিপি, ইন্দোর তাম্রলিপি প্রভৃতি থেকেও নানা তথ্যাদি জানা যায়।
মুদ্রা (Coins)
গুপ্ত যুগের প্রচুর সোনা, রূপা ও তামার মুদ্রা পাওয়া গেছে। মুদ্রাগুলিতে উৎকীর্ণ বিভিন্ন দেব-দেবী ও রাজা-রানির মূর্তি, সমুদ্রগুপ্তের বীণাবাদনরত মূর্তি প্রভৃতি থেকে রাজাদের ধর্মবিশ্বাস, তাঁদের শখ প্রভৃতি নানা বিষয় জানা যায়। প্রথমদিকের গুপ্ত মুদ্রায় সোনার পরিমাণ বেশি থাকলেও স্কন্দগুপ্তের শেষদিকের মুদ্রায় সোনার পরিমাণ হ্রাস পায়। এর দ্বারা দেশের আর্থিক দুর্বলতার কথা প্রমাণিত হয়।
স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও শিল্প (Architecture, Sculpture and Art)
গুপ্ত সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে প্রচুর স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলার নিদর্শন পাওয়া গেছে। এগুলি থেকে গুপ্ত যুগের শিল্পের কথা জানা যায়। মথুরা, নালন্দা ও বারাণসী ছিল গুপ্ত যুগের শ্রেষ্ঠ শিল্পকেন্দ্র। এইসব স্থানের বিভিন্ন ধ্বংসাবশেষ এবং দেওগড় দশাবতার মন্দির, আইহোল ও ভিতারগাঁওয়ের মন্দিরগুলি নানা তথ্য সরবরাহ করে। গুপ্ত যুগের ইতিহাস রচনায় এগুলির গুরুত্ব অপরিসীম।