রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বকে আইনের উৎস বলে বিবেচনা করা হয়। আইনের ইতিহাস আলোচনা করলে লক্ষ্য করা যায় যে, সমাজ বিবর্তনের ধারায় বিভিন্ন উপাদান আইন সৃষ্টিতে সহায়তা করেছে। সুতরাং নানা সামাজিক উপাদান আইনের উৎস হিসাবে কাজ করেছে বলা যেতে পারে। খ্যাতনামা আইনবিদ হল্যান্ডের মতে আইনের ছয়টি উৎস হলঃ প্রথা, ধর্ম, বিচারালয়ের সিদ্ধান্ত, বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা, ন্যায়বিচার এবং আইনসভা।
(১) প্রথা (Custom): আইনের প্রাচীন উৎস হল প্রথা। সমাজ জীবনে দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত আচার-ব্যবহার, রীতি-নীতি প্রথায় পরিণত হয়। হল্যান্ডের মতে, কোন ব্যক্তি কোন এক সময়ে আকস্মিকভাবে বা কোন উদ্দেশ্যে বিশেষ রীতি সমাজে প্রবর্তন করে। পরবর্তীকালে তা অন্য সকলে মেনে চলে এবং প্রথার সৃষ্টি হয়। উদাহরণ হিসাবে মাঠের মধ্যে পায়ে চলার পথের উল্লেখ করা যায়। প্রাচীনকালের সমাজজীবনের প্রথার প্রাধান্য ছিল। বিভিন্ন পরিবার বা গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধের মীমাংসার ক্ষেত্রে প্রথাকে অনুকরণ করা হত। সমাজে প্রচলিত প্রথাগুলি তদানীন্তন ধর্মবিশ্বাস বা নীতিবোধের অনুগামী ছিল বলে সেগুলি মান্য করা হত। আধুনিক কালের অনেক রাষ্ট্রের আইনের মধ্যে প্রথাভিত্তিক আইনের সন্ধান মেলে। ভারতে হিন্দু ও মুসলমান আইনের ব্যাপক অংশ প্রথার ভিত্তিতে রচিত হয়েছে। ইংল্যান্ডে প্রথাগত আইন (common law) শাসন ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। সুতরাং আইনের উৎস হিসাবে প্রথার গুরুত্ব অস্বীকার করতে পারা যায় না।
(২) ধর্ম (Religion): প্রাচীন সমাজ ব্যবস্থায় ধর্মের প্রভাব ছিল অত্যন্ত প্রবল। ধর্মীয় অনুশাসনকে লোকে অমোঘ বলে মনে করত। সামাজিক আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় বিধিনিষেধগুলি ধর্মকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। সুতরাং ধর্ম প্রত্যন্ত ও পরোক্ষভাবে আইনের বিবর্তনে সহায়তা করেছিল। সমাজজীবনে শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা প্রতিষ্ঠায় ধর্মীয় অনুশাসন প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। ধর্মের সমর্থনে সামাজিক রীতিনীতি বা প্রথা স্থায়িত্ব লাভ করেছি। মানবজীবনে ধর্মীয় অনুশাসন জীবন মৃত্যুর বিষয় হিসাবে গুরুত্ব লাভ করে, ধর্মীয় অনুমোদন ছাড়া প্রথার বৈধতা বিচার করা সম্ভব হত না। মানুষ বিশ্বাস করত যে, রাজার আদেশ ঈশ্বরের আদেশ, সুতরাং তা অমান্য করা ক্ষমাহীন অপরাধ। প্রাচীন মিশর, মেসোপটেমিয়া, ভারত, গ্রীস ও রোমের ইতিহাসে আইনের পিছনে ধর্মীয় অনুমোদনের সাক্ষ্য রয়েছে। ভারতের হিন্দু ও মুসলমান আইনে বিবাহ, সম্পত্তির বণ্টন, উত্তরাধিকার প্রভৃতি বিষয়ে ধর্মের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। সুতরাং আইনের উৎস হিসাবে ধর্মের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।
(৩) বিচারালয়ের সিদ্ধান্ত (Judicial decisions): নতুন নতুন পরিবেশ, মানুষের জীবনযাত্রার পার্থক্য, জটিলতা প্রভৃতি কারণে পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থার নানা সমস্যার উদ্ভব হয়। সমাজ জীবনের জটিলতার জন্য প্রথা ও ধর্ম পূর্ব উপযোগিতা হারিয়ে ফেলে, সমাজের দ্বন্দ্ব মীমাংসার দায়িত্ব এসে পড়ল রাজা বা দলপতির ওপর। প্রথা ও ধর্মের অসম্পূর্ণতার ক্ষেত্রে দলপতি বা রাজা আপন বিচারবুদ্ধির প্রয়োগে বিরোধের মীমাংসা করতেন। এই বিচারের রায় ভবিষ্যতে আইন বলে গণ্য হল। বর্তমান কালে বিচারের রায় অনেক আইন সৃষ্টি করে থাকে। সমাজ গতিশীল, কিন্তু আইন স্থিতিশীল। পরিবর্তনশীল সমাজের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য আইনের পরিবর্তন প্রয়োজন। তাছাড়া আইনের অস্পষ্টতা দূর করবার জন্য বা অসম্পূর্ণতা পূরণ করবার জন্য বিচারকগণকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। বিচারকগণের এই সিদ্ধান্তগুলি পরবর্তীকালে অনুরূপ মামলার ক্ষেত্রে বিনা দ্বিধায় প্রয়োগ করা হয়। একে বিচারের নজীর (judicial precedents) বলা হয়। এভাবে বিচারালয়ের সিদ্ধান্ত নতুন আইন সৃষ্টি করে।
(৪) বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা (Scientific commentaries): কোন দেশের আইন ব্যবস্থা সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা আইনের উৎস বলে গণ্য হয়। আইনজ্ঞ পণ্ডিত ব্যক্তিগণের মতামত সরাসরি আইন বলে গণ্য হয় না; কিন্তু তাঁদের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও আলোচনা দ্বারা আইনের প্রকৃত উদ্দেশ্য প্রতিফলিত হয়। বিচারকগণ বিচারের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ স্বীকার করে রায়দান করেন। ইংল্যান্ডে কোক (Coke), ব্লাকস্টোন (Blackstone), ডাইসী (Dicey) প্রভৃতি পণ্ডিতদের টীকা-ভাষ্য আইনের উৎসস্বরূপ বলে গণ্য হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টোরী (Story) কেন্ট (Kent) এবং ভারতে মনু, জীমূতবাহন প্রভৃতির ব্যাখ্যা ও আলোচনা আইনের প্রভূত পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সম্ভব করেছে।
(৫) ন্যায়বিচার (Equity): স্বাভাবিক ন্যায়বোধ, সততা ও সমদৃষ্টিভঙ্গীর সাহায্যে বিচার করাকে ন্যায়বিচার বলা হয়। যেক্ষেত্রে আইনের কোন সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকে না অথচ ন্যায় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন হয়, সেক্ষেত্রে ন্যায়বিচার আইনের অসম্পূর্ণতা দূর করতে সহায়তা করে। ন্যায়বিচারকে বিচারক সৃষ্ট আইন বলে গণ্য করা হলেও উভয় ক্ষেত্রে বিচার পদ্ধতির পার্থক্য রয়েছে। প্রথম ক্ষেত্রে (Case law) বিচারক প্রচলিত আইনের ব্যাখ্যা করে থাকেন। কিন্তু ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে বিচারক নিজস্ব ন্যায়বোধের দৃষ্টিতে বিচার করে থাকেন এবং এর দ্বারা নতুন আইন সৃষ্টি করেন। সমাজের ন্যায়বোধের সঙ্গে প্রচলিত আইনের অনেক সময় পার্থক্য দেখা যায়; কারণ, আইন দীর্ঘদিন প্রবর্তিত থাকলে পরিবর্তনশীল সমাজের সঙ্গে সামঞ্জস্য হারিয়ে ফেলে। এক্ষেত্রে ন্যায়বিচারই আইনের ন্যায়নিষ্ঠার মর্যাদা রক্ষা করে। ন্যায়বিচার আইনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎস বলেই স্বীকৃত।
(৬) আইন প্রণয়ন (Legislation): আধুনিক কালে আইনসভার দ্বারা আইন প্রণয়ন আইনের প্রধান উৎস বলে স্বীকৃত। জনগণের প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত আইনসভা জনমতের প্রয়োজন ও প্রকৃতি অনুযায়ী আইন প্রণয়ন করতে পারে। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রয়োজন পূরণের জন্য অসংখ্য আইন প্রণয়ন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। আইনসভার দ্বারা সেই কার্য সুসম্পন্ন হতে পারে। সুতরাং আইনসভাই বর্তমানে একমাত্র উৎস হিসাবে গণ্য হয়েছে।