১২০৬ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ ঘুরির অন্যতম বিশ্বস্ত অনুচর কুতুবউদ্দিন আইবক কর্তৃক দিল্লিতে স্বাধীন সুলতানি শাসনের প্রবর্তন থেকে ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের মৃত্যু পর্যন্ত সময়কে ভারত ইতিহাসে মধ্যযুগ বলা হয়। ১২০৬ থেকে ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে মুঘল-বংশীয় বাবরের সিংহাসন আরোহণের পূর্ব পর্যন্ত সময় ‘সুলতানি শাসন’ বা ‘সুলতানি যুগ’ বলে পরিচিত। সুলতানি যুগে একমাত্র সৈয়দ-বংশীয় খিজির খাঁ ব্যতীত দিল্লির সকল স্বাধীন নরপতিই ‘সুলতান’ উপাধি ধারণ করেছিলেন। ‘সুলতান’ শব্দটি কোরানে ‘শক্তি’ বা ‘সামর্থ্যের’ প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং ‘সুলতান’ অর্থে সাধারণভাবে স্বাধীন নরপতি বোঝায়।
সুলতানি শাসনাধীন ভারতীয় ইতিহাসের প্রচুর উপাদান পাওয়া গেছে। এই উপাদানগুলিকে—(১) সরকারি দলিলপত্র, (২) ঐতিহাসিকদের রচনা, (৩) আঞ্চলিক ভাষা ও সাহিত্য, (৪) বিদেশি পর্যটকদের বিবরণ এবং (৫) মুদ্রা ও শিল্প-নিদর্শন প্রভৃতি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়।
সরকারি দলিলপত্র
ভারতে মুসলিম শাসনের সূচনা থেকে শাসকশ্রেণী নিজ নিজ শাসনকালের বিবরণ লিপিবদ্ধ করার ব্যবস্থা করেন এবং সমগ্র মধ্যযুগ ধরে এই ধারা অব্যাহত ছিল। শাসকশ্রেণীর লিখিত এইসব বিবরণ এবং সমসাময়িক দলিলপত্র; যেমন—বাদশাহি হুকুমনামা, ভূমিদানের দলিল, সরকারি চিঠিপত্র সুলতানি যুগের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কালের প্রকোপে দলিলপত্রের অধিকাংশ নষ্ট হয়ে গেছে, তবু যেটুকু পাওয়া গেছে ঐতিহাসিকদের কাছে তার মূল্য অপরিসীম।
ঐতিহাসিকদের রচনা
সমকালীন বহু ঐতিহাসিক সুলতানী যুগের ইতিহাস রচনা করেছেন। রাজানুগ্রহপুষ্ট ঐতিহাসিকদের রচনা পক্ষপাতদুষ্ট ও অতিরঞ্জিত হলেও, ইতিহাসের উপাদান হিসেবে তাঁদের রচনাবলী গুরুত্বপূর্ণ।
- ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে মির মহম্মদ মাসুম রচিত ‘তারিখ-ই-সিন্ধ’ (Tarikh-i-Sind) গ্রন্থ থেকে আরবদের সিন্ধু বিজয়ের বিবরণ পাওয়া যায়।
- আবু নাসের বিন উতবি রচিত ‘কিতাব-উল-ইয়ামিনি’ গ্রন্থে সুবুক্তগীন ও সুলতান মামুদের রাজত্বকাল থেকে ১০২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ধারাবাহিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ আছে।
- হাসান নিজামি রচিত ‘তাজ-উল-মাসির’ গ্রন্থে ১১৯২ থেকে ১২২৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অর্থাৎ মহম্মদ ঘুরির ভারত জয়, কুতুবউদ্দিন আইবকের জীবন ও কার্যাবলী এবং ইলতুৎমিসের রাজত্বকালের প্রথম পর্বের বিভিন্ন ঘটনার বিবরণ আছে।
- মিনহাজ-উস-সিরাজ রচিত ‘তাবাকাত-ই-নাসিরী’ গ্রন্থে মহম্মদ ঘুরির রাজ্যজয় থেকে শুরু করে ১২৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দিল্লি সুলতানির বিভিন্ন ঘটনার বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়।
- মহম্মদ-বিন-তুঘলক ও ফিরোজ তুঘলকের সভাসদ জিয়াউদ্দিন বারানী রচিত ‘তারিখ-ই-ফিরোজশাহী’ গ্রন্থে গিয়াসউদ্দিন বলবনের রাজত্বকাল থেকে ফিরোজ শাহের রাজত্বকালের প্রথম ছ’বছরের বিবরণ পাওয়া যায়।
- কায়কোবাদ থেকে গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের আমল পর্যন্ত দিল্লি দরবারের সভাকবি পদে নিযুক্ত বিশিষ্ট কবি ও ঐতিহাসিক আমির খসরু রচিত ‘কিরান-উস-সাদাইন’, ‘মুফতা-উল-ফৎ’, ‘আসিক’, ‘তুঘলকনামা’ প্রভৃতি গ্রন্থে সমকালীন ইতিহাসের বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। তাঁকে ‘ভারতের তোতাপাখি’ বলা হয়। তাঁর রচিত ‘খাজাইন-উল-ফুতুহ’ গ্রন্থ থেকে আলাউদ্দিন খলজির দাক্ষিণাত্য অভিযান, তাঁর প্রশাসনিক সংস্কার, ভারতে মোঙ্গল আক্রমণ প্রভৃতি বিষয়ে অনেক কিছু জানা যায়।
- সম্রাট ফিরোজ তুঘলক রচিত ‘ফতোয়া-ই-ফিরোজশাহী’ গ্রন্থ থেকে তাঁর ব্যক্তিগত ধর্মীয় ধারণা ও শাসনব্যবস্থার ধারাবাহিক বিবরণ পাওয়া যায়।
- চতুর্দশ শতকের খ্যাতনামা ঐতিহাসিক খাজা আবদুল্লাহ মালিক ইসামি রচিত ‘ফুতুহ-উস-সালাতিন’ গ্রন্থে সুলতান মামুদের আমল থেকে মহম্মদ-বিন-তুঘলকের আমল পর্যন্ত ঘটনার বিবরণ আছে।
- শামস-ই-সিরাজ আফিফ রচিত ‘তারিখ-ই-ফিরোজশাহী’ গ্রন্থটি ফিরোজ তুঘলকের রাজত্বকালের মূল্যবান উপাদান হিসেবে স্বীকৃত।
- লোদি-বংশের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে আব্বাস শেরওয়ানি রচিত ‘তারিখ-ই-শেরশাহী, নিয়ামতউল্লার রচিত ‘মাখজাম-ই-আফগান’ এবং আবদুল্লা রচিত ‘তারিখ-ই-দাউদি’ উল্লেখযোগ্য।
আঞ্চলিক ভাষা ও সাহিত্য
চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকে ভক্তি আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ভারতের বিভিন্ন অংশে আঞ্চলিক সাহিত্যের বিকাশ ঘটে। এইসব সাহিত্যকীর্তিগুলি ইতিহাসের অমূল্য উপাদান হিসেবে স্বীকৃত। বাংলার মঙ্গলকাব্য, কবীরের দোঁহা, সুরদাস-নানকের ভজন এবং মারাঠি ও গুরুমুখি সাহিত্যগুলি থেকে ইতিহাসের নানা তথ্যাদি জানা যায়।
বিদেশি পর্যটকদের বিবরণ
সুলতানি আমলে যে সব বিদেশি পর্যটক ভারতে আসেন তাঁদের রচনা থেকেও ইতিহাসের নানা তথ্যাদি জানা যায়।
- বিখ্যাত আরব পন্ডিত আল-বিরুনি রচিত ‘তহকক-ই-হিন্দ’ বা ‘কিতাব-উল-হিন্দ’ গ্রন্থে দশম শতাব্দীর শেষ ও একাদশ শতাব্দীর সূচনায় উত্তর ভারতের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়।
- আফ্রিকার মরক্কোর অধিবাসী ইবন বতুতা চোদ্দো বছর ভারতে ছিলেন এবং এর মধ্যে আট বছর তিনি দিল্লিতে বাস করে সরকারের বহু গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত ছিলেন। তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্ত ‘কিতাব-উল-রাহেলা’ বা ‘রাহেলা’ মহম্মদ-বিন-তুঘলকের রাজত্বকালের গুরুত্বপূর্ণ বিবরণ।
- ইতালির মার্কো পোলো, নিকোলো কন্টি, পর্তুগিজের পায়েজ, বারবোসা, নুনিজ, পারস্যের আবদুর রজ্জাক, রাশিয়ার নিকিতিন, চিনের মা হুয়ান প্রমুখের রচনাও ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে স্বীকৃত।
মুদ্রা ও শিল্প-নিদর্শন
মুদ্রা ও শিল্প নিদর্শন প্রভৃতি প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলি সুলতানি যুগের ইতিহাসের মূল্যবান উপাদান। ঐতিহাসিক স্ট্যানলি লেনপুলের মতে, সুলতানি যুগের মুদ্রাগুলি ইতিহাসের প্রধান ও নিশ্চিত ভিত্তিস্বরূপ। তাঁর মতে, মুদ্রাগুলি থেকে রাজাদের রাজবংশ, রাজত্বকাল, রাজ্যের আয়তন, রাজার সিংহাসনারোহণের সময়, ধর্মমত, প্রতিবেশী রাজ্যগুলির সঙ্গে সম্পর্ক, ধাতু-শিল্পের অবস্থা প্রভৃতি বহু বিষয়ের কথা জানা যায়। এছাড়া সুলতানি যুগের মসজিদ, স্মৃতিসৌধ, প্রাসাদ, দুর্গ এবং ললিতকলার বিভিন্ন নিদর্শন থেকেও ইতিহাসের তথ্যাদি জানা যায়।