রাষ্ট্র হল একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান। সমাজ অনেক প্রতিষ্ঠানের সমন্বয় বিশেষ। সমাজে থাকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি। রাষ্ট্র হল সমাজের মধ্যে একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কারবার। গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল থেকে শুরু করে বর্তমান কালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ পর্যন্ত রাষ্ট্র সম্পর্কে বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন।
রাষ্ট্রের সংজ্ঞা (Definition of State)
রাষ্ট্রের উৎপত্তি ঘটে বহুকাল আগে প্রাচীন গ্রিসে। প্রাচীন গ্রীক ও রোমানরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বাস করত। একে নগর-রাষ্ট্র (City State) বলা হত। রোমান দার্শনিকরা নগর রাষ্ট্রগুলিকে সিভিটাস (Civitas) এবং গ্রীক দার্শনিকরা নগর রাষ্ট্রগুলিকে পলিস (Polis) বলে অভিহিত করেছিলেন। পরে টিউটনযুগে রাষ্ট্রের চেহারা যখন বড় আকার ধারণ করে তখন রাষ্ট্রকে বোঝানোর জন্য স্ট্যাটাস (Status) শব্দটি ব্যবহার করা হয়। ষোড়শ শতাব্দীর ইতালির বিখ্যাত চিন্তাবিদ ম্যাকিয়াভেলি তাঁর The Prince গ্রন্থে রাষ্ট্র (State) শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। বর্তমানে রাষ্ট্র শব্দটি যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যকে বুঝানোর জন্যও ব্যবহৃত হয়; যেমন পশ্চিমবঙ্গ (State of West Bengal)।
গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল বলেন, “রাষ্ট্র হল স্বাবলম্বী ও পূর্ণাঙ্গ জীবনযাপনের উদ্দেশ্য সংগঠিত কয়েকটি পরিবার ও গ্রামের সমষ্টি।”
রোমান দার্শনিক সিসেরো বলেন, “রাষ্ট্র হল অধিকার সম্বন্ধে সমচেতনায় ও সুযোগ সুবিধায় পারস্পরিক অংশ গ্রহণে ঐক্যবদ্ধ বিপুল সংখ্যক জনসমষ্টি।”
রেনেসাঁস যুগের লেখক গ্রোশিয়াস বলেন, “সকলের উপকার ও অধিকারের সুবিধাভোগের জন্য ঐক্যবদ্ধ স্বাধীন মানুষের পূর্ণাঙ্গ সমাজ হল রাষ্ট্র।”
ফরাসি লেখক বোডিন 1576 সালে বলেন, “রাষ্ট্র হল পরিবারবর্গ ও তাদের সাধারণ ধনসম্পত্তির একটি মিলিত সংস্থা যা একটি চূড়ান্ত ক্ষমতা ও যুক্তির দ্বারা পরিচালিত হয়।”
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন বলেন, “রাষ্ট্র হল আইনানুসারে সংগঠিত নির্দিষ্ট ভূখন্ডের অধিকারী জনসমষ্টি।” তিনি রাষ্ট্রের আইনমূলক সংজ্ঞা দিয়েছেন।
মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার বলেন, “রাষ্ট্র হল একটি সংগঠন, যার নির্দিষ্ট ভূখন্ডের অধিবাসীদের সমাজে সামাজিক শৃঙ্খলা আইনের দ্রুত বজায় রাখে। আইন রাষ্ট্রের সরকারকে তাহা বলিয়া দেয়। এই সরকারের য়োগ করিবার অধিকার আছে।”*
রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য বা উপাদান (Characteristics of State)
গার্নারের সংজ্ঞা অনুযায়ী রাষ্ট্রের চারটি বৈশিষ্ট্য বা উপাদান আছে। এগুলি হল—(1) জনসমষ্টি, (2) নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, (3) সরকার, ও (4) সার্বভৌমত্ব। রাষ্ট্র সৃষ্টি হয় এই চারটি উপাদানের সমবায়। এর মধ্যে কোনো একটি উপাদানের অভাব হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। এছাড়াও রাষ্ট্রের দুটি গৌণ বৈশিষ্ট্য বা উপাদান রয়েছে; এগুলি হল—(5) স্থায়িত্ব ও (6) আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।
(1) জনসমষ্টি (Population): সমাজ থেকে রাষ্ট্রের জন্ম হয়। মানুষ ছাড়া সমাজ হয় না। সমাজ গড়ে ওঠে যখন মানুষ একসাথে থাকে। পূর্বে দশ হাজার জনসংখ্যাকে রাষ্ট্রের জন্য কাম্য জনসংখ্যা হিসেবে বিবেচনা করা হত। কিন্তু বর্তমানে এই ধারণা পরিবর্তন হয়েছে। রাষ্ট্রের সুশাসনের জন্য কাঙ্খিত জনগণের প্রয়োজনীয়তার কথা আজ কেউ ভাবে না। সুশাসনের সাথে প্রয়োজনীয় আর্থিক সম্পদ দেশের আছে কিনা তার উপর দেশের জনসংখ্যা কাম্য কি অকাম্য তা নির্ভর করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, ইজরাইল প্রভৃতি রাষ্ট্র অল্পসংখ্যক জনসমষ্টি নিয়ে গঠিত। আবার ভারত, চীন, রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশ বৃহৎ জনসমষ্টি নিয়ে গঠিত। সুতরাং বর্তমানে জনসংখ্যাকে রাষ্ট্র গঠনের মাপকাঠি হিসেবে ধরা হয় না। অবশ্য গার্নার, ল্যাস্কি, ম্যাকাইভার প্রমুখ রাষ্ট্রের উপাদান হিসাবে বহুসংখ্যক জনসমষ্টির কথা বলেছেন। তবে রাষ্ট্র গঠনের উপাদান হসাবে জনসংখ্যার কোন সীমা নির্দিষ্ট নেই।
আধুনিক রাষ্ট্রের জনসমষ্টিকে কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়; যথা—(ক) পূর্ণ নাগরিক, (খ) অসম্পূর্ণ নাগরিক, (গ) বিদেশী ও (ঘ) প্রজা। যারা রাষ্ট্রে বাস করে তারা সকলে এক জাতির লোক নয়। কেউ স্থায়ীভাবে রাষ্ট্রে বাস করে এবং রাষ্ট্রের কাজে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করে, রাষ্ট্রের আইনসম্মত সভ্য এবং রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে। এদের বলা হয় পূর্ণ নাগরিক (full-fledged citizen)। আবার রাষ্ট্রের বাসিন্দাদের মধ্যে যারা রাষ্ট্রের কাজে অংশ নিতে পারে না তারা অসম্পূর্ণ নাগরিক (semi-citizen); যথা, শিশু, পাগল ইত্যাদি। এছাড়া কিছু বৈদেশিক অস্থায়ীভাবে রাষ্ট্রে বাস করে, তারা রাষ্ট্রে বাস করলেও রাষ্ট্রের কাজে অংশ গ্রহণ করতে পারে না, তাদের বলা হয় বিদেশী (alien)। আবার নির্দিষ্ট কোন ভূখণ্ড যদি অপর রাষ্ট্রের অধীন ঔপনিবেশ হয় তবে তার জনগণকে প্রজা (Subject) বলা হয়। আবার রাষ্ট্রে যদি এমন কিছু লোক থাকে যারা বিদেশী বা নাগরিক নয় কিন্তু তাদের যদি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য থাকে, তবে তাদের বলা হয় স্বজাতীয় (National)।
(2) নির্দিষ্ট ভূখণ্ড (Territory):
(3) সরকার (Government): নাবিক ছাড়া জাহাজ যেমন অচল, তেমনি শাসকবিহীন রাষ্ট্র বিচ্ছিন্ন জনসমষ্টি ছাড়া আর কিছু নয়। রাষ্ট্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল সরকার। সরকার হল রাষ্ট্রের ইচ্ছার রূপকার। মানুষ যখন যাযাবর ছিল তখন রাষ্ট্রের জন্ম হয়নি। রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে যখন বিচ্ছিন্ন মানুষ সুসংবদ্ধ হয়েছে। আবার বিচ্ছিন্ন মানুষকে সুসংবদ্ধ করেছে সরকার। জনগণকে আইন ও শৃঙ্খলায় আবদ্ধ করার সংগঠন হল সরকার। সমিতি বা ক্লাবের যেমন নিয়ম কানুন থাকে এবং তাকে কার্যকর করে কার্যকরী কমিটির সদস্যগণ, ঠিক তেমনি রাষ্ট্রের আইন কানুনকে কার্যকর করে সরকার। সরকারের মারফতই জনসাধারণের ইচ্ছা রূপ পায়। সরকার যে রাষ্ট্রের আইন তৈরি করে তা রাষ্ট্রেরই ইচ্ছা প্রকাশ করে। সরকারের ইচ্ছা তথা রাষ্ট্রের ইচ্ছাকে যারা মানে না তারা রাষ্ট্রদ্রোহী। অবশ্য সরকারের বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষ থাকে। এই বিরোধীপক্ষ যতক্ষণ পর্যন্ত সরকারি ক্ষমতা অধিকার করছে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা সরকার বিরোধী থাকে, কিন্তু যখন বিরোধীপক্ষ সরকার গঠন করে আইন পাস করে তখন তা হবে রাষ্ট্রের ইচ্ছা। সরকার হল রাষ্ট্রের একটি বিশেষ শক্তি সংস্থা। রাষ্ট্র ও সরকার এমনভাবে মিশিয়া আছে যে, হবসের মতো অনেকেই সরকারকে রাষ্ট্র বলে ভুল করেছে।
রাষ্ট্রকে যারা পরিচালনা করে তারা শাসক অর্থাৎ যারা রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা ব্যবহার করে তারাই রাষ্ট্রের শাসক। সরকারের মোট তিনটি বিভাগ রয়েছে; যথা, আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। এই তিনটি বিভাগের কর্মচারীদের নিয়ে সরকার গঠিত হয়।
(4) সার্বভৌমত্ব (Sovereignty):
(5) স্থায়িত্ব (Permanence): রাষ্ট্রকে স্থায়ী হতে হবে। যে রাষ্ট্র ক্ষণভঙ্গুর তা রাষ্ট্রের পদবাচ্য নয়। রাষ্ট্রের সরকার পাল্টাতে পারে কিন্তু তা বলে রাষ্ট্রের কোন পরিবর্তন হয় না। অবশ্য, রাষ্ট্রের সীমানা কখনো বাড়তে পারে বা কমতে পারে কিন্তু তাতে রাষ্ট্র বিনষ্ট হয় না। রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব বলিতে চিরন্তন কিছু বোঝায় না। রাষ্ট্র বিলুপ্ত হতে পারে। কোন রাষ্ট্র যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে অন্য রাষ্ট্রের অধীন হতে পারে বা স্বেচ্ছায় অন্য রাষ্ট্রের সাথে যুক্ত হতে পারে অথবা নিজ রাষ্ট্রকে ভেঙ্গে টুকরা টুকরা করে অনেক রাষ্ট্রের সৃষ্টি করতে পারে। যে কালে যে রাষ্ট্র স্থায়ী তখন সে কালে সেই রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব একটি বৈশিষ্ট্য।
(6) আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি (International Recognition): রবার্ট গার্নার বলেন, “রাষ্ট্র হল আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মধ্যে প্রবেশ করার আইনসঙ্গত যোগ্যতা এবং আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা পূরণের ইচ্ছা ও ক্ষমতা।” একটি দেশকে রাষ্ট্র পদবাচ্য হতে হলে তাকে অপর রাষ্ট্র কর্তৃক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হবে। কোন রাষ্ট্র যতক্ষণ পর্যন্ত না অপর রাষ্ট্র কর্তৃক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত সে রাষ্ট্র পদবাচ্য হয় না। তাইওয়ান (চীন প্রজাতন্ত্র), ফিলিস্তিন, উত্তর সাইপ্রাস, প্রভৃতি অনেক রাষ্ট্রের দ্বারা স্বীকৃত হয় নাই। এইসব দেশ তাদের কাছে রাষ্ট্র নয়।
পরিশেষে বলা যায়, কালের পরিবর্তনের সাথে সাথে রাষ্ট্রের সংজ্ঞা ও উপাদান অনেক পরিবর্তন হয়েছে। একদিন যখন বড়ো বড়ো সাম্রাজ্য ছিল তখন বহু রাষ্ট্রকে নিয়ে সাম্রাজ্য গড়ে উঠত। কিন্তু আজ সাম্রাজ্য ভেঙ্গে গেছে, তার ঔপনিবেশগুলি স্বাধীন রাষ্ট্র পদবাচ্য হয়েছে। ভারতবর্ষ ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ঔপনিবেশ, সে আজ স্বাধীন রাষ্ট্র। ভারতবর্ষ ভেঙ্গে হয়েছে—ভারত ও পাকিস্তান। আবার পাকিস্তান ভেঙ্গে হয়েছে—পাকিস্তান ও বাংলাদেশ।
রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য
রাষ্ট্রের ধারণা তত্ত্বগত। রাষ্ট্রের বাস্তবরূপ প্রকাশ পায় সরকারের মাধ্যমে। সেজন্য রাষ্ট্র ও সরকার প্রায় প্রতিশব্দ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। হবস তাঁর লেভিয়াথান গ্রন্থের রাষ্ট্র ও সরকারকে একই অর্থে ব্যবহার করেছেন। ফরাসি সম্রাট চতুর্দশ লুই বলেছিলেন, “আমিই রাষ্ট্র” (I am the State)। কিন্তু রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে কয়েকটি মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান।
(১) রাষ্ট্র নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের অধিকারী, বাহ্যিক শাসন থেকে মুক্ত সংগঠিত জনসমাজ, যার একটি সরকার আছে। সরকার হল রাষ্ট্রের অনেক উপাদানের মধ্যে একটি উপাদান। সরকারের মাধ্যমে রাষ্ট্র তার কাজ করে এবং তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করে।
(২) দেশের সকল মানুষকে নিয়ে রাষ্ট্র গঠিত। রাষ্ট্রের শাসন পরিচালনার কাজে যারা নিযুক্ত থাকে একমাত্র তারাই শাসকমণ্ডলী বা সরকার। শুধুমাত্র আইন, বিচার ও শাসন বিভাগের কর্মচরীরাই সরকার।
(৩) রাষ্ট্র একটি নির্দিষ্ট সীমিত ভূখন্ডকে বোঝায় এবং সরকার বলতে কোন নির্দিষ্ট ভূখণ্ডকে বোঝায় না।
(৪) রাষ্ট্র একটি চিরন্তন প্রতিষ্ঠান, কিন্তু সরকার একটি স্থায়ী শাশ্বত প্রতিষ্ঠান নয়। আজ গণতান্ত্রিক সরকার আছে, কাল হয়তো স্বৈরাচারী সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে।