ভারতের সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের সাফল্য
ভারতের সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের সার্থক রূপায়ণের পথে বহু অন্তরায় থাকা সত্ত্বেও এর সাফল্যের বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ভারতে সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের সাফল্যের উল্লেখযোগ্য দিকগুলি হল
1. রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ: ভারতে সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার নাগরিকদের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ এনে দিয়েছে। এর ফলে ১৮ বছর এবং তার উর্ধ্বে সমস্ত ভারতীয় নাগরিক দেশের শাসন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ লাভ করেন।
2. গণসার্বভৌমত্বের বাস্তব রূপায়ণ: ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারীরূপে জনগণের কথা তুলে ধরে গণসার্বভৌমত্বের নীতি ঘোষিত হয়েছে। ভারতে সার্বভৌম শক্তির আধার হল জনগণ। সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের স্বীকৃতির ফলে গণসার্বভৌমত্বের এই নীতির বাস্তব রূপায়ণ ঘটেছে।
3. নির্বাচনে অংশগ্রহণের হার বৃদ্ধি: ভারতীয় জনগণের মধ্যে দারিদ্র, নিরক্ষরতা ও অজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও ভোটদানের হার উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলির তুলনায় যথেষ্ট সন্তোষজনক। সমীক্ষা অনুযায়ী, ১৯৮৯ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত লোকসভার নির্বাচনগুলিতে ভোটদানের গড় হার ছিল ৫৩.১ শতাংশ। রাজ্য বিধানসভাগুলির নির্বাচনেও জনগণের ভোটদানের গড় হার অত্যন্ত ইতিবাচক। সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ্য, ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচনে ৮২.৩০ শতাংশ ভোটদাতা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন।
4. রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি: ভারতে নাগরিকদের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের সার্থক রূপায়ণের ইঙ্গিত দেয়। ১৯৭৫ সালে জারি করা জরুরি অবস্থার ফলাফল বিচার বিবেচনা করে ভারতীয় জনগণ ১৯৭৭ সালে লোকসভার সাধারণ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে রাজনৈতিক সচেতনতার পরিচয় দেন। অনুরূপভাবে ১৯৮০ সালের সাধারণ নির্বাচনে জনতা দলের অন্তর্কলহের বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে ভোটদাতারা আবার কংগ্রেস দলকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনেন। বর্তমানে ভারতীয় নাগরিকরা সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারকে সরকার পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করায় ক্রমশ দক্ষ হয়ে উঠছেন। ফলে সরকার পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বুলেটের পরিবর্তে ব্যালটই গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।
5. সামাজিক তাৎপর্য: ভোটাধিকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অধিকার লাভ করার পর বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের অনগ্রসর শ্রেণির মানুষজন নিজেদের সামাজিক ও অন্যান্য অধিকার সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতনতা অর্জন করেছেন।
6. গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা: ভারতে সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলেছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশের অধিবাসী হিসেবে ভারতবর্ষের নাগরিকরা সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারাকে অক্ষুণ্ণ রেখে চলেছেন।
ভারতের সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ব্যর্থতা
ভারতের সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের সাফল্যের পথে বেশ কিছু অন্তরায় বিদ্যমান। যেসব কারণে ভারতে সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার সম্পূর্ণ ফলপ্রসূ হয়নি সেই কারণগুলি হল:
1. শিক্ষার অভাব: সাম্প্রতিক সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী সমগ্র ভারতে সাক্ষরতার হার মাত্র শতকরা ৭৪.০৪ ভাগ (২০১১ সালের গণনা অনুসারে)। এ থেকে প্রমাণ হয় যে, প্রায় শতকরা ২৬ ভাগ মানুষ নিরক্ষর। সমালোচকদের মতে, প্রকৃত শিক্ষা ও রাজনৈতিক চেতনার অভাবে ভোটদাতাদের এক বিরাট অংশ নির্বাচনের সময় যোগ্য প্রার্থী নির্বাচন করতে পারে না। এর ফলে সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার নীতির প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়, গণতন্ত্র তার উৎসমূলেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
2. আর্থিক প্রলোভন: ভারতে এক বিশাল জনসমষ্টি এখনও দারিদ্র্য সীমারেখার নীচে বসবাস করে। এদের মধ্যে আর্থিক অনিশ্চয়তা অত্যন্ত প্রকট। বলা বাহুল্য যে, নির্বাচনের সময় এরা সহজেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বিত্তবান প্রার্থীদের আর্থিক প্রলোভনের শিকার হয়। এর ফলে একদিকে যেমন অসৎ ও অযোগ্য প্রার্থীরা অর্থের বিনিময়ে নির্বাচনে জয়লাভ করতে সমর্থ হয়, অন্যদিকে তেমনি সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের নীতির পরাজয় ঘটে।
3. জাতপাত ও সম্প্রদায়ভিত্তিক মনোভাব: নির্বাচনের সময় জাতপাত, ধর্ম, ভাষা ও সম্প্রদায়ভিত্তিক অন্ধ আনুগত্যের ভিত্তিতে ভোটদাতাদের একটি বৃহৎ অংশ এখনও তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ। করে থাকেন। অনেক সময় ভোটদানের ক্ষেত্রে সংকীর্ণ অঞ্চলভিত্তিক মনোভাবও প্রাধান্য লাভ করে। এর ফলে সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের মতো প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক নীতির অপপ্রয়োগ ঘটে।
4. অন্ধ আবেগের প্রাধান্য: সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার নীতির সাফল্য ভোটদাতাদের যুক্তিনিষ্ঠ ও বিচক্ষণ মনোভাবের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু ভারতে ভোটদাতাদের একটি বৃহৎ অংশ নির্বাচনের সময় প্রায়শ অন্ধ আবেগের বশে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে থাকেন। এ ধরনের বহু দৃষ্টান্ত অতীতে দেখা গেছে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধির হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৮৪ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত লোকসভা নির্বাচনে রাজীব গান্ধির নেতৃত্বে কংগ্রেস দলের বিপুল জয়ের কথা এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
5. রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন: রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারকে অনেকাংশে প্রহসনে পরিণত করেছে। বহু কুখ্যাত অপরাধী, এমনকি দাগি আসামিও সন্ত্রাস ও ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে নির্বাচনে জয়লাভ করে লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভার সদস্যপদ দখল করে। ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের এক কলঙ্কিত দিক।
6. প্রার্থীর জৌলুসের প্রতি গুরুত্বদান: ভারতের নির্বাচনি রাজনীতিতে প্রার্থীর ব্যক্তিগত জৌলুস (Glamour)-ও ভোটদাতাদের প্রবলভাবে আকর্ষণ করে থাকে। রুপোলি পর্দার নায়কনায়িকারা এইভাবেই নির্বাচনে জয়লাভ করতে সক্ষম হন। এই ধরনের নির্বাচনকে অনেকে জনমতের যথার্থ প্রতিফলন বলে মেনে নিতে চাননি। সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের সাফল্যের ক্ষেত্রে এটিও একটি অন্যতম অন্তরায়।
এ ছাড়া অন্যের অনুকরণে যা নির্দেশে অযোগ্য প্রার্থীকে ভোটদান, স্বজনপ্রীতি, নির্বাচনি দুর্নীতি ও কারচুপি, বিত্তবান ও এলিট শ্রেণির প্রাধান্য, মিথ্যা প্রচার ইত্যাদি কারণকেও সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের সাফল্যের পথে অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।