মানবজীবনে শিক্ষা আনে চেতনা, আর সেই চেতনা মানুষের জীবনের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন, পরিশীলন ও পরিবর্ধনের মাধ্যমে মানুষের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সাধনে যে সম্যক ভূমিকা নিয়ে থাকে তা সহজেই অনুমেয়। বস্তুত মানুষ নিজস্ব সর্বাঙ্গীণ কাম্য ও বাঞ্ছিত বিকাশ বৃদ্ধির স্বার্থে শিক্ষাকে উল্লেখযোগ্য হাতিয়ার না করে পারে না।
কিন্তু কিভাবে শিক্ষণ মানুষের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সাধনের লক্ষ্যকে বাস্তবে রূপদান করে তাই-ই এখন বিচার্য বিষয়। আমরা জানি, প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থায় যে শিক্ষা দেওয়া হত তাতে প্রতিটি মানুষের নিজস্ব আগ্রহ, আকুলতা, রুচি, প্রবণতা প্রভৃতিকে গুরুত্ব না দিয়ে আবাল-বৃদ্ধ- বনিতা প্রত্যেককেই বয়স্ক শিক্ষকদের এবং সমাজের বয়স্কদের মত ও পথানুসারে তথ্যবহুল, তত্ত্বভারাক্রান্ত, বুলিসর্বস্ব শিক্ষাকে উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হত। ফলত মানুষের ব্যক্তিত্বের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের সকল পরিবেশ ধুলায় ধূসরিত হত।
শিক্ষার লক্ষ্য আজ কিন্তু ব্যক্তি-মানুষের সর্বাঙ্গীণ, সুসংহত ও সর্বোত্তম বিকাশ সাধনের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন করছে। মানুষ ও ব্যক্তিকে নিয়ে গড়ে ওঠে সমাজ। তাই ব্যক্তি-মানুষই শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু এবং ব্যক্তি-মানুষের ব্যক্তিত্বের স্বাভাবিক, সর্বাঙ্গীণ, সুসংহত ও সর্বোত্তম বিকাশকেই শিক্ষার লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে এবং শিক্ষার মাধ্যমে প্রতিটি ব্যক্তি-মানুষের অন্তর্নিহিত সম্ভাবনার সম্পূর্ণ, স্বাভাবিক ও সর্বাঙ্গীণ বিকাশকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
মানুষের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সাধন প্রক্রিয়ার মধ্যে মানুষের শারীরিক, মানসিক, প্রাক্ষোভিক, বৌদ্ধিক, সামাজিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বিকাশকেই মুখ্য গণ্য করা হয়। এই জাতীয় শিক্ষার লক্ষ্যে তাই মানুষের জীবনের প্রত্যেক দিককে সমানভাবে বিকশিত করার বিষয়টি বিশেষভাবে কাম্য।
এই প্রেক্ষিতে শিক্ষা যেমন মানুষের উপযুক্ত শারীরিক বিকাশ এনে ব্যক্তি-মানুষকে সুস্বাস্থ্যের ও সুস্থ মনের অধিকারী করে তোলে তেমনি তার মানসিক সামর্থ্যের প্রাক্ষোভিক সুসংহতির, বৌদ্ধিক পরিণমনের, সামাজিক সংগতিসাধনের, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক গুণসমূহের সম্যক বিকাশ সাধনের মাধ্যমে তার সর্বাঙ্গীণ বিকাশ প্রক্রিয়াকে বাস্তবায়িত করে তোলে।
বস্তুত শিক্ষার এই লক্ষ্যের প্রেক্ষিতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী শিক্ষাবিদেরা সকলেই ব্যক্তি-মানুষের সকল দিকের ও অঙ্গের সুষম ও সর্বোত্তম বিকাশকে বিশেষভাবে চেয়েছেন। এঁরা সবাই মনে করেন যে প্রত্যেক ব্যক্তি-মানুষকে ভাল নাগরিক হওয়ার আগে সর্বাঙ্গীণভাবে ভাল ব্যক্তি- মানুষ হিসেবে বিকশিত হয়ে উঠতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন যখন ব্যক্তি-মানুষকে শুধুমাত্র নাগরিক হওয়ার পরিবর্তে উপযুক্ত ব্যক্তি হয়ে ওঠার শিক্ষা দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন তখন অবশ্যই ব্যক্তি-মানুষের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সাধন করাকেই শিক্ষার লক্ষ্য হিসেবে ভাবেন।
পরিশেষে ব্যক্তিত্বকামী পার্সি নানকে মেনে বলতে হয় যে শিক্ষার লক্ষ্য হবে এমন অবস্থা ও পরিবেশ সৃষ্টি করা যাতে মানুষের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সাধন সম্ভব হয়ে ওঠে। এরই পাশাপাশি ব্যক্তির সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সাধনের মাধ্যমেই তার নিজস্ব সকল সম্ভাবনার স্বাধীন স্বতঃস্ফূর্ত স্বাভাবিক বিকাশকে মূর্ত হতে সহায়তা করবে এবং তাকে নৈতিক ও সামাজিকভাবে সুদক্ষ জীব হিসেবে বিকশিত করে তুলবে।