বর্তমান যুগে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতির ফলে মানবজীবনে পরিবর্তন ঘটেছে এবং এই পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিকে কোন সংবিধানই স্থায়িত্বের দাবি করতে পারে না। জাতীয় জীবনের প্রয়োজন ও পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। টমাস পেইনের মতে, প্রতি যুগের মানুষের যুগোপযোগী কার্য সম্পাদনের স্বাধীন সুযোগ থাকা একান্তই কাম্য। সাধারণভাবে যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধান দুষ্পরিবর্তনীয় হলেও ভারতের সংবিধান সংশোধনের পদ্ধতি বিচিত্র ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। সাধারণত সংশোধন পদ্ধতির ভিত্তিতে সংবিধানকে সুপরিবর্তনীয় (flexible) ও দুষ্পরিবর্তনীয় (rigid)—এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়। সাধারণ আইন পাসের পদ্ধতিতে সংবিধানের সংশোধন সম্ভব হলে তাকে সুপরিবর্তনীয় সংবিধান বলা হয়, আর যে ক্ষেত্রে সংশোধনের জন্য বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয় সেই সংবিধানকে দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান বলা হয়। সংশোধন পদ্ধতির দিক থেকে ভারতীয় সংবিধান সুপরিবর্তনীয়তা ও দুষ্পরিবর্তনীয়তার সামঞ্জস্য বিধান করেছে। সংবিধান সংশোধনের বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
(১) সংবিধানের অন্তর্গত কতকগুলি বিষয় সম্পর্কে পরিবর্তন বা সংশোধন সাধারণ আইন পাসের পদ্ধতি অর্থাৎ সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে সম্ভব হয়। যেমন, রাজ্যের অন্তর্ভুক্তি, রাজ্যের পুনর্গঠন, অঙ্গরাজ্যে দ্বিতীয় কক্ষের প্রবর্তন বা বিলোপ সম্পর্কে সহজেই সংবিধানের সংশোধন হতে পারে।
(২) সংবিধানের অন্য কতকগুলি বিষয়ে নিম্নরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। সংশোধনের প্রস্তাব প্রথমে বিল আকারে পার্লামেন্টের যে-কোন কক্ষে উপস্থিত করতে হয়। ঐ বিল পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের মোট সদস্য সংখ্যার অধিকাংশ এবং উপস্থিত ও ভোটপ্রদানকারী সদস্যের দুই-তৃতীয়াংশ দ্বারা সমর্থিত হওয়া প্রয়োজন। তার পর ঐ বিল অঙ্গরাজ্যগুলির অন্ততঃ অর্ধেক আইনসভায় অনুমোদিত হওয়া প্রয়োজন। এরূপে অনুমোদিত বিল রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাভ করলে সংবিধানের সংশোধন হয়।
(৩) সংবিধানের অন্যান্য বিষয়ের সংশোধনের জন্য সংশোধন প্রস্তাব পার্লামেন্টের যে কোন কক্ষে উপস্থিত করা হয়। বিলগুলি পার্লামেন্টের প্রত্যেক কক্ষের ভোট প্রদানকারী সদস্যের দুই-তৃতীয়াংশের সংখ্যাধিক্যে এবং মোট সদস্যসংখ্যার অধিকাংশের দ্বারা গৃহীত হবার পর রাষ্ট্রপতির সম্মতিলাভ করলে সংবিধানের সংশোধন হয় (৩৬৮ ধারা)।
সুতরাং ভারতীয় সংবিধান অংশত সুপরিবর্তনীয় এবং অংশত দুষ্পরিবর্তনীয়। ভারতীয় সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি সামঞ্জস্যপূর্ণ বলা যেতে পারে।
◇ মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত ধারা সংশোধন বিতর্ক: সংবিধান বার বার পরিবর্তিত হবে কিনা তা নির্ভর করে সমাজে প্রভাবশালী শ্রেণীর সুবিধা-অসুবিধার ওপর। ভারতের ক্ষেত্রেও তা হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসকশ্রেণী সংবিধানের ব্যবস্থা অথবা আদালত-কর্তৃক সংবিধানের ব্যাখ্যা অসুবিধাজনক বা অকাম্য বলে মনে করলে সংবিধানের যে কোন অংশের পরিবর্তন করতে পারে। আজ পর্যন্ত 106 বার ভারতীয় সংবিধানের সংশোধন হয়েছে। প্রসঙ্গত, ১৯৬৭ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারী গোলকনাথ ও অন্যান্য বনাম পাঞ্জাব রাজ্য (Goloknath & Others vs. The State of Punjab) মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট অভিমত দেন যে, রায় দানের দিন থেকে তৃতীয় অধ্যায়ে বর্ণিত মৌলিক অধিকারকে সঙ্কুচিত করবার বা বিনষ্ট করবার জন্য কোন সংশোধন প্রস্তাব পাশের ক্ষমতা পার্লামেন্টের থাকবে না। আদালতের অভিমতে পার্লামেন্টে সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়ে। এই অসুবিধা দূর করবার জন্য ২৪তম সংশোধন আইন পাশ হয়। নতুন সংশোধন আইনে ৩৩৮ এবং ১৩ ধারার সংশোধন করে নতুনভাবে লিখিত হয়। প্রথমত, ৩৬৮ ধারা মতে পার্লামেন্ট সংবিধানের যে কোন অংশের পরিবর্তন, সংযোজন বা কোন অংশ বর্জন করতে পারবে। দ্বিতীয়ত, ৩৬৮ ধারা অনুসারে কোন সংশোধনের ক্ষেত্রে ১৩ ধারাটি প্রযোজ্য হবে না, অর্থাৎ ১৩ ধারায় আইন প্রণীত হলে তা বাতিল বলে গণ্য হবে না। তৃতীয়ত, পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের গৃহীত বিলে রাষ্ট্রপতি সম্মতি প্রদান করবেন। নতুন সংশোধন আইন পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। সংবিধানের ২৪তম এবং ২৯তম সংশোধন আইনের বৈধতা সম্পর্কে প্রশ্ন উঠলে সুপ্রিম কোর্ট কেশবানন্দ ভারতী মামলার রায়ে (এপ্রিল, ১৯৭৩) বলেছেন যে, সংবিধানের মৌলিক কাঠামো বজায় রেখে পার্লামেন্ট যে-কোন ধারার পরিবর্তন করতে পারে। পরিবর্তনের ব্যবস্থা স্বীকার না করলে, জনগণের মধ্যে সংবিধান-বহির্ভূত ব্যবস্থা গ্রাহণের প্রবণতা দেখা দেবে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে শাসক দল তীব্র সমালোচনা করেন। সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিবর্তনের অধিকার পার্লামেন্টের নেই বলে মত প্রকাশ করলেও মৌলিক কাঠামোর কোন ব্যাখ্যা দেয় নি। এই অসুবিধা দূর করবার জন্য ১৯৬৭ সালে ৪২তম সংশোধন আইন পাস করবার প্রয়োজন হয় বলে শাসক দল অভিমত দেন। ৪২তম সংশোধনী আইনে পার্লামেন্টের সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতার ওপর সকল বাধা অপসারণ করা হয়। সংশোধনের বিষয়বস্তু সম্পর্কে আদালতের এক্তিয়ারও রহিত করা হয়েছে। ১৯৭৭ সালে শাসকগোষ্ঠীর পরিবর্তন ঘটলে পুনরায় সংবিধানের সংশোধন করা হয়। ১৯৮০ সালের ৯ই মে মিনার্ভা মিলস মামলায় (Minarva Mills Case) সুপ্রিম কোর্ট রায়দান প্রসঙ্গে ৪২তম সংবিধান সংশোধন আইনের ৫৫ ধারা (Section 55) অবৈধ বলে ঘোষণা করে। এই ধারার বলে পার্লামেন্ট ৩৬৮ ধারা অনুযায়ী সংবিধান সংশোধনের চূড়ান্ত ক্ষমতা লাভ করেছে।