সার্বভৌমত্বের যে চরম, অবাধ, অসীম রূপের কল্পনা করা হয়, বাস্তব দৃষ্টিতে তা সম্ভব নয় বলে অনেক লেখক মনে করেন। লর্ড ব্রাইস তাঁর “American Commonwealth” গ্রন্থে বলেছেন যে, বাধাবন্ধনহীন, অসীম, চরম ক্ষমতাসম্পন্ন সার্বভৌমের সন্ধান কোন রাষ্ট্র ব্যবস্থায় মিলবে না। ব্লুন্টশলীর মতে, রাষ্ট্রের ক্ষমতা অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে নিজস্ব প্রকৃতি ও নাগরিকের অধিকার রাষ্ট্র এবং বাহ্যিক দিক থেকে অন্যান্য রাষ্ট্রের অধিকারের দ্বারা সীমাবদ্ধ। ল্যাস্কি বলেছেন যে, কর্তৃত্বের সীমাবদ্ধতা দর্শনের একটি মৌল বিষয়।
সীমাবদ্ধ সার্বভৌমত্বের সীমাবদ্ধতার বিচার
(১) ধর্মীয় নীতি ও জনগণের অধিকার: ধর্মীয় ও নৈতিক অনুশাসনের দ্বারা সার্বভৌম ক্ষমতা সীমাবদ্ধবলে প্রাচীন লেখকগণের অনেকেই মনে করেছেন। রাষ্ট্র সাধারণভাবে ধর্মীয় অনুশাসন ও নৈতিক মূল্যবোধকে মেনে চলে। নৈতিক বিশ্বাসের বিরোধিতা করে কোনো রাষ্ট্রই জনগণের অসন্তোষ বহ্নিতে ধ্বংস হতে চায় না। ফরাসী দেশের চরম স্বৈরাচারী শাসক চতুর্দশ লুইও জনগণের ওপর জোর করে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম চাপিয়ে দেন নি। সার্বভৌম ক্ষমতার ঊর্ধ্বে শাশ্বত নৈতিক বিধি বিরাজমান বলে অনেকে মনে করেন। সুতরাং সার্বভৌম ক্ষমতা ধর্মীয় অনুশাসন বা নৈতিক বিশ্বাসের দ্বারা সীমাবদ্ধ। অধ্যাপক গার্নার-এর মতে, এগুলি রাষ্ট্রের আইনগত সার্বভৌমত্বের ওপর প্রকৃত কোনো সীমা নির্দেশ করতে পারে না। সার্বভৌমত্বের ধারণা মূলত আইনগত এবং আইনের দৃষ্টিতে আলোচিত নিয়ন্ত্রণগুলি সার্বভৌম ক্ষমতার প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ বলে গণ্য করা যায় না। আবার জনগণের অধিকারের দ্বারা সার্বভৌমত্ব সীমাবদ্ধ এ ধারণাও স্বীকার করা যায় না। অধিকার রাষ্ট্রের সৃষ্টি; এটা রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত। রাষ্ট্রীয় আইনের সহায়তা ভিন্ন অধিকার স্বেচ্ছাচারিতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য। সুতরাং নাগরিকের অধিকার সার্বভৌমত্বের যে সীমা নির্দেশ করে, তা সার্বভৌম কর্তৃত্বের দ্বারাই স্বীকৃত।
(২) সাংবিধানিক আইন: অনেকে মনে করেন যে, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব সাংবিধানিক আইনের দ্বারা সীমাবদ্ধ। কিন্তু এর যৌক্তিকতা স্বীকার করা হয় না। সংবিধানের মাধ্যমে সরকারের ক্ষমতা নির্দিষ্ট ও সীমিত হতে পারে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সরকারকে সংবিধানের সীমা মেনে কাজ করতে হয়, কিন্তু রাষ্ট্রকে নয়। সার্বভৌম শক্তি সংবিধানের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করে এবং প্রয়োজনমত সংশোধন, পরিবর্তন ও পরিবর্জন দ্বারা সংবিধানের প্রাধান্য সংরক্ষণ করে। সুতরাং সার্বভৌমত্ব সাংবিধানিক আইন দ্বারা সীমাবদ্ধ তা স্বীকার করা যায় না।
(৩) আন্তর্জাতিক আইন: আন্তর্জাতিক আইন বা অন্য রাষ্ট্রের অধিকার দ্বারা সার্বভৌমত্ব সীমাবদ্ধ এ যুক্তিও মেনে নেওয়া যায় না। আইনগত রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা সকল প্রকার বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ হতে মুক্ত। আন্তর্জাতিক আইন বা নীতি নিয়মকে বিভিন্ন প্রকার প্রয়োজনের ভিত্তিতে স্বেচ্ছায় মেনে নিতে পারে। জাতীয় আইন বা রাষ্ট্রীয় আইনের মতো আন্তর্জাতিক আইনের পিছনে কোনো এমন নিপীড়নমূলক শক্তি নেই যা এই আইনকে বাধ্যতামূলকভাবে প্রয়োগ করতে পারে।
(৪) বহুত্ববাদী সীমা: সার্বভৌমত্বের চরম তত্ত্ব বা একত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গীকে বহুত্ববাদীরা স্বীকার করেন না। সমাজের বিভিন্ন সংঘ বা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রাষ্ট্র অন্যতম সংগঠন মাত্র। প্রত্যেক সামাজিক সংঘের নিজস্ব নিয়মকানুন রয়েছে, যা সংঘের সদস্যগণ মেনে চলেন। সংঘগুলি তাদের নিজস্ব ক্ষেত্রে প্রকৃত ক্ষমতা ভোগ করে। সুতরাং সংঘগুলির স্বাতন্ত্র্য স্বীকার করলে সার্বভৌমত্বের অবাধ প্রয়োগ সম্ভব হবে না। বাস্তব সামাজিক অবস্থার বিচারে বলা যায় যে, সার্বভৌম কখনই অসীম ক্ষমতা ভোগ করে নি। চরম ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে সার্বভৌম ক্ষমতার বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
মূল্যায়ন
সার্বভৌমত্বের অবাধ ও অসীম প্রকৃতির স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারা যায়। সুতরাং আইনের দৃষ্টিতে সার্বভৌমত্বের কোনো সীমা নেই। বাস্তব ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় যে, কোনো রাষ্ট্রই জনমতকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করতে চায় না। জনমত উপেক্ষিত হলে অসন্তোষ ও বিক্ষোভের আগুন বিপ্লবের রূপ ধারণ করতে পারে এবং শাসকের ধ্বংসসাধন করতে পারে। এ উপলব্ধির জন্য রাষ্ট্র আপন অস্তিত্বরক্ষার স্বার্থে জনমতকে মেনে চলে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও কোনো রাষ্ট্র সম্পূর্ণ স্বৈরাচারী ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে না। সুতরাং তত্ত্বের দিক হতে সার্বভৌম ক্ষমতা চরম ও অসীম হলেও ব্যবহারিক জীবনে তার প্রয়োগ দেখা যায় না।