মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেন যে, মৌর্য শাসনের প্রতি ব্রাহ্মণ্য সম্প্রদায়ের বিদ্বেষের ফলে মৌর্য কর্তৃত্বের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের জন্য ব্রাহ্মণ্য প্রতিক্রিয়া (Brahmanical Reaction) দায়ী ছিল। মগধে দুর্বল মৌর্য কর্তৃত্বের উপর আঘাত হানেন সম্রাট বৃহদথের ব্রাহ্মণ সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ, অন্ধ্রে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রাহ্মণ সাতবাহনদের আধিপত্য এবং ব্রাহ্মণ চেতবংশ কলিঙ্গ দখল করে। ডঃ শাস্ত্রী তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে বেশ কয়েকটি যুক্তির অবতারণা করেছেন।
- অশোক ছিলেন একজন শূদ্র রাজা। তিনি পশুবলি বন্ধ করে দিলে ব্রাহ্মণদের যাগযজ্ঞ বাধাপ্রাপ্ত হয়।
- অশোক একটি শিলালিপিতে ব্রাহ্মণদের সম্পর্কে দর্পভরে বলেন যে, “এতদিন যাদের ভূদেব (পৃথিবীর দেবতা) বলে মনে করা হত, তিনি তাদের মিথ্যা বা ভণ্ড দেবতা বলে প্রতিপন্ন করেছেন।” এই উক্তি ব্রাহ্মণদের ক্ষুব্ধ করে।
- অশোক ‘ধর্মমহামাত্র’ নামক রাজকর্মচারী নিয়োগ করে ব্রাহ্মণদের কর্তৃত্বে আঘাত হানেন।
- ব্রাহ্মণরা শাস্তির ক্ষেত্রে ও আদালতে কিছু বিশেষ সুবিধা ভোগ করত। অশোক দণ্ডসমতা ও ব্যবহার-সমতার নীতি প্রবর্তন করে ব্রাহ্মণদের বিশেষ অধিকার খর্ব করেন।
ডঃ শাস্ত্রী বলেন যে, অশোকের মৃত্যুর পর তাঁর দুর্বল উত্তরাধিকারীদের আমলে ব্রাহ্মণরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
সমালোচনা (Criticism)
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর যুক্তিগুলি ডঃ হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী মানতে রাজি নন।
(১) অশোক শূদ্রবংশজাত ছিলেন না। তিনি ছিলেন ক্ষত্রিয় বংশের সন্তান। অশোকের বহু পূর্বে উপনিষদ ও শ্রুতিশাস্ত্রে পশুবলি নিষিদ্ধ হয়েছিল। সুতরাং পশুবলি নিষিদ্ধ করে অশোক কোনো শাস্ত্রবিরোধী কাজ করেন নি।
(২) অশোকের শিলালিপিতে ব্রাহ্মণদের সম্পর্কে ব্যবহৃত ‘ভণ্ড দেবতা’ কথাটি সঠিক নয়। ডঃ সিলভা লেভি উক্ত শিলালিপিটির ভিন্নতর ব্যাখ্যা দিয়েছেন যা অধিকাংশ পণ্ডিত গ্রহণ করেছেন।
(৩) ‘ধম্মমহামাত্র’-দের নিয়োগ করে অশোক ব্রাহ্মণদের অধিকার ও কর্তৃত্বের উপর কোনো আঘাত হানেন নি তাদের অন্যতম কর্তব্য ছিল ব্রাহ্মণ-সহ সকল প্রজার মঙ্গলসাধন। ব্রাহ্মণরাও ধম্মমহামাত্র পদে নিযুক্ত হতে পারত।
(৪) দণ্ডসমতা ও ব্যবহার-সমতা দ্বারা ব্রাহ্মণদের বিশেষ অধিকার খর্ব করা হয় নি বা ব্রাহ্মণদের সকল বর্ণের মানুষের সঙ্গে এক করে দেওয়া হয় নি। এর দ্বারা সারা দেশে ব্রাহ্মণদের জন্য একই ধরনের দণ্ড এবং বিচারালয়ে একই ধরনের আইন প্রবর্তিত হয়। এছাড়া বলা দরকার যে, এই সময় ব্রাহ্মণরা কোনও বিশেষ অধিকার ভোগ করত না। মহাভারত, অর্থশাস্ত্র প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, রাজদ্রোহে অভিযুক্ত ব্রাহ্মণদের জলে ডুবিয়ে মারা হত।
(৫) ডঃ শাস্ত্রী-র মতে অশোকের উত্তরাধিকারীদের সাথে ব্রাহ্মণদের তীব্র বিরোধ শুরু হয়—এই বক্তব্য সঠিক নয়। কলহন রচিত রাজতরঙ্গিনী থেকে জানা যায় যে, কাশ্মীরের মৌর্য-রাজ জলৌকার সঙ্গে ব্রাহ্মণদের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল।
(৬) বিভিন্ন উপাদান থেকে জানা যায় যে, ১৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পুষ্যমিত্র শুঙ্গের বিদ্রোহের বহু পূর্বেই মৌর্য সাম্রাজ্য (Maurya Empire) দুর্বল হয়ে পড়েছিল। কাশ্মীর, গান্ধার, বিদর্ভ এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন অংশ আগেই স্বাধীন হয়ে যায়। পুষ্যমিত্র কর্তৃক বৃহদথের অপসারণ কোনো বিদ্রোহ নয়—এটি ছিল প্রাসাদ বিপ্লব। ডঃ রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় বলেন যে, একদল বিক্ষুব্ধ ব্রাহ্মণদের নেতা হিসেবে নয়— সেনাবাহিনীর উপর কর্তৃত্বের জন্যই পুষ্যমিত্র শুঙ্গের উদ্দেশ্য সফল হয়।