তৃতীয় আলেকজান্ডার (Tsar Alexander III) 1881 থেকে 1894 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাশিয়ার জার ছিলেন। তিনি 10 মার্চ, 1845 খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে জন্ম গ্রহণ করেন। দ্বিতীয় আলেকজান্ডার বিপ্লবীদের দ্বারা নিহত হলে, 14 মার্চ, 1881 খ্রিস্টাব্দে তাঁর দ্বিতীয় পুত্র তৃতীয় আলেকজান্ডার জারের সিংহাসনে বসেন। 22 এপ্রিল, 1865 খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় আলেকজান্ডারের বড় ভাই নিকোলাস আকস্মিক মৃত্যু হয়। নিকোলাস মৃত্যুশয্যায় তাঁর বাগদত্তা ডেনমার্কের রাজকুমারী ডাগমার (মারিয়া ফায়োডোরোভনা নামে পরিচিত) সাথে তৃতীয় আলেকজান্ডারের বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং 9 নভেম্বর, 1866 খ্রিস্টাব্দে তাঁদের বিবাহ সম্পন্ন হয়।
প্রতিক্রিয়াশীলতা
জার তৃতীয় আলেকজান্ডার ছিলেন দারুণ প্রতিক্রিয়াশীল স্বভাবের লোক। তিনি তাঁর পিতামহ নিকোলাসের মত “এক জার, এক গীর্জা ও এক রাশিয়ার (One Tzar, One Church. One Russia) আদর্শ ঘোষণা করেন। তিনি পোবিডোনোস্টেভ (Pobedonostsev) নামে প্রতিক্রিয়াশীল মন্ত্রীর প্রভাবে পড়ে সর্বপ্রকার উদারনৈতিক ভাবধারার চরম শত্রুতে পরিণত হন। সংবিধানবাদ, উদারতন্ত্র ও গণতন্ত্রকে তিনি বিজাতীয় ও রুশবিরোধী ভাবধারা বলে বাতিল করে দেন। সংবাদপত্র, প্রতিক্রিয়াশীলতা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজনৈতিক দলগুলির ওপর তিনি কঠোর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্ব শাসনের অধিকার লোপ করেন। জিমন্যাশিয়া বা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ওপরে কঠোর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করা হয়। যদি কোন ছাত্র অর্থোডক্স গীর্জার বিরোধিতা করত, তবে তার নাম বিদ্যালয় থেকে কেটে দেওয়া হত। জার তৃতীয় আলেকজান্ডার প্রাদেশিক ও জেলা পরিষদ বা জেমস্টভোর (Zemstvo) ক্ষমতা লোপ করেন। তিনি স্থানীয় পরিষদগুলির সদস্যদের নির্বাচনের পরিবর্তে মনোনয়ন করার নিয়ম চালু করেন। স্থানীয় স্বায়ত্ব শাসন সভাগুলিতে তিনি ভূস্বামীদের প্রাধান্য ফিরাতে চেষ্টা করেন। জেমেষ্টভোর কর্মচারীদের তিনি সিভিল সার্ভিসের অধীনে এনে তাদের ওপর প্রাদেশিক শাসনকর্তার নিয়ন্ত্রণ চাপান।
সামন্ততন্ত্র ও রুশীকরণ
জার তৃতীয় আলেকজান্ডার মনে করতেন যে, অভিজাত ও সামন্ত শ্রেণীই হল জারতন্ত্রের আসল শক্তি। এজন্য তিনি ভূমিদাস প্রথার উচ্ছেদের আইনকে পছন্দ করতেন না। তিনি সামন্ততন্ত্র ও রুশীকরণ “বাষ্টার্ড ফিউডালিজম” (Bastard Feudalism) বা অবৈধ সামন্ততন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যে চেষ্টা চালান। “ল্যান্ড ক্যাপটেন” (Land captain) নামে এক শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগ করে তিনি সামন্তপ্রথা ফিরাবার চেষ্টা করেন। জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের ভূমিদাস উচ্ছেদ আইনের বিরুদ্ধে কৃষকদের দুটি প্রধান অভিযোগ ছিল, যথা: (১) জমির জন্যে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ক্ষমতা কৃষকদের ছিল না। প্রতি বছর ক্ষতিপূরণের টাকা যোগাড় করতে কৃষকদের ক্ষেতের ফসল নীচু দামে বিক্রি করতে হত এবং ঋণ নিতে হত। (২) কৃষকদের যে জমি দেওয়া হত তাহা ছিল প্রধানতঃ পতিত বা অনুর্বরা জমি এবং তার পরিমাণ ছিল খুব কম। জার তৃতীয় আলেকজান্ডার কৃষকদের এই সকল অভিযোগের প্রতিকার করেন নি। অধিকন্তু তিনি তাদের ওপর পুনরায় সামন্ত প্রথা চাপাবার চেষ্টা চালান। রাশিয়ায় ভূমিদাস প্রথা উচ্ছেদের পর গ্রামীণ জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছিল। ১৮৬১ খ্রীঃ এই জনসংখ্যা ছিল ৭৩ মিলিয়ন। ১৮৯৭ খ্রীঃ তা ১২৫ মিলিয়নে পৌঁছে যায়। এর ফলে জমির চাহিদা ও জমির দাম বহুগুণ বাড়ে। কৃষকদের ক্ষতিপূরণ ও রাজস্বের মিলিত অর্থ দিয়ে খাদ্য সঙ্কুলান হত না। এজন্য ঘন ঘন কৃষক বিদ্রোহ হতে থাকে। জার তৃতীয় আলেকজান্ডার কৃষকদের ক্ষোভ দূর করার কোন চেষ্টা করেননি।
রুশীকরণ নীতি
রাশিয়ায় পোল, ফিন, ইহুদী প্রভৃতি বহু অ-রুশ জাতি বসবাস করত। জার তৃতীয় আলেকজান্ডার এই জাতি গোষ্ঠীগুলির স্বায়ত্ব শাসনের দাবী অগ্রাহ্য করেন। তিনি তাদের মাতৃভাষা ও সংস্কৃতিকে দমিয়ে রুশীকরণ নীতি (Russification) নেন। তিনি এই জাতিগোষ্ঠীগুলিকে রুশ ভাষা শিখতে বাধ্য করেন। তাদের মাতৃভাষার চর্চাকে নিরুৎসাহিত করা হয়। ইহুদিদের ওপর নির্মম নীতি চালান হয়। জার আলেকজান্ডারের বাল্যকালে তাঁর শিক্ষকরা তাঁর মনে নিষ্ঠুর ইহুদি বিদ্বেষ ছড়ান। জার মনে করতেন যে, রাশিয়ার যাবতীয় বিপ্লবী মতগুলি ইহুদিরাই ছড়ায়। এজন্য তিনি ইহুদিদের পেইল বা বস্তী এবং গ্রামে বসবাস করতে বাধ্য করেন। তিনি তাদের শহর থেকে হঠিয়ে দেন।
শিল্প নীতি
জার তৃতীয় আলেকজান্ডার শিল্প গঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতেন। তাঁর অর্থমন্ত্রী কাউন্ট উইটি ব্যাপক শিল্প স্থাপনের কাজে হাত দেন। ফরাসী মূলধনের সহযোগিতায় ব্যাপক রেল নির্মাণ এবং শিল্প স্থাপনের কাজ আরম্ভ হয়। সূতীবস্ত্র, লৌহ ও তৈল শিল্পের অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটে। রাশিয়ায় কাপড়ের কলগুলির এত উন্নতি ঘটে, যে ক্ষেত্রে ১৮৮১ খ্রীঃ তারা ৯-৭ মিলিয়ন টন তুলা আমদানি করা হত সেক্ষেত্রে ১৮৯৪ খ্রীঃ ১৫-৪ মিলিয়ন টন তুলা আমদানি করা হয়। আশির ও নব্বই-এর দশকে রুশ শিল্পের অভূতপূর্ব বিস্তার ঘটে। জার্মান ও ফরাসী মূলধন লগ্নী দ্বারা রাশিয়ার শিল্পে মূলধনের সরবরাহ করা হয়। ১৮৯০ খ্রীঃ রাশিয়ায় লগ্নী করা বিদেশী মূলধনের পরিমাণ ছিল প্রায় ২০০ মিলিয়ন রুবল। বেলপথ, অস্ত্র কারখানা, লোহা ঢালাই কারখানা প্রভৃতি ভারী শিল্পের অসাধারণ বিকাশ ঘটে। কৃষকদের ওপর শিল্প কর চাপিয়ে শিল্পের মূলধন আদায় করা হয়। ইউক্রেনে কয়লা, লোহা ও তৈল শিল্প, পোল্যান্ডে বস্ত্র, ধাতু শিল্প গড়ে ওঠে। রুশ শিল্পে পুঁজিবাদী বিকাশ তীব্র হতে থাকে।
বৈদেশিক নীতি
জার তৃতীয় আলেকজান্ডারের রাজত্বকালে বৈদেশিক নীতি এক নতুন মোড় নেয়। তিনি 18 জুন, 1881 খ্রীঃ অষ্টিয়া ও জার্মানীর সঙ্গে দ্বিতীয় তিন সম্রাটের চুক্তি স্থাপন করেন। বলকান অঞ্চলে অস্ট্রিয়া-রাশিয়ার মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে দ্বিতীয় তিন সম্রাটের জোটের গুরুত্ব কমে যায়। এরপর 18 জুন, 1887 খ্রিস্টাব্দে জার্মানীর সাথে রি-ইনসিওরেন্স সন্ধি (Reinsurance Treaty) স্বাক্ষর করেন। জার্মান সম্রাট দ্বিতীয় কাইজার একতরফাভাবে রি-ইনসিওরেন্স চুক্তি নাকচ করেন। রাশিয়ার সাথে চুক্তি খারিজের ফলে জার বিরক্ত হন এবং ফ্রান্সের সঙ্গে রাশিয়া নিরপেক্ষতা ত্যাগ করে 1893 খ্রীঃ ফ্রাঙ্কো-রুশ সামরিক চুক্তি সম্পাদন করে। এর ফলে ত্রিশক্তি আঁতাতের প্রথম ধাপ রচিত হয়।
জার তৃতীয় আলেকজান্ডার 1 নভেম্বর, 1894 খ্রিস্টাব্দে 49 বছর বয়সে টার্মিনাল কিডনি রোগে অসুস্থ হয়ে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর জার দ্বিতীয় নিকোলাস রাশিয়ার জার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন।