খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের মধ্যভাগে গুপ্ত সাম্রাজ্যের (উত্তর ভারত) সমসাময়িক কালে মধ্য ও দক্ষিণ ভারতে বাকাটক বংশ (Vakataka Dynasty) বা বাকাটক রাজ্য গড়ে ওঠে। খ্রিস্টীয় তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ শতকের মধ্যে দাক্ষিণাত্যে যে সব শক্তিশালী রাজ্য গড়ে ওঠে তার মধ্যে বাকাটক রাজ্য ছিল সর্বশ্রেষ্ট। বাকাটক রাজ্য উত্তরে মালওয়া এবং গুজরাটের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে দক্ষিণে তুঙ্গভদ্রা নদী এবং পশ্চিমে আরব সাগর থেকে পূর্বে ছত্তিশগড়ের প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বাকাটকরা ছিল ব্রাহ্মণ। বাকাটক রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা হলেন বিন্ধ্যশক্তি (আ: ২৫০-২৭০ খ্রিঃ)। বাকাটক বংশের এক তাম্রফলকে বিন্ধ্যশক্তি (Vindhyashakti)-কে ‘বাকটক-বংশকেতু’ বলে আভহিত করা হয়েছে।
বিন্ধ্যশক্তির পুত্র প্রথম প্রবরসেন (Pravarasena I) ছিলেন বাকাটক বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা এবং শ্রেষ্ট রাজা। তিনি নর্মদা পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার করেন। তাঁর রাজধানী ছিল পুরীক। তিনি চারটি অশ্বমেধ যজ্ঞ করে ‘সম্রাট’ উপাধি নেন। তাঁর অন্যান্য উপাধি ছিল ধর্মমহারাজ, হরিতিপুত্র। তিনি গোঁড়া ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সমর্থক ছিলেন। তিনি নাগাদের সাথে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। পুরাণ অনুসারে তাঁর চার পুত্র ছিল এবং পুত্রদের মধ্যে বাকাটক সাম্রাজ্য চারটি শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। বাকাটক বংশের দুটি শাখা পরিচিত এবং দুটি অজানা। বাকাটক সাম্রাজ্যের পরিচিত শাখা দুটি হল প্রভারপুর-নন্দীবর্ধন শাখা এবং বৎসগুল্ম শাখা।
প্রভারপুর-নন্দীবর্ধন শাখা যেমন মহারাষ্ট্রের বর্তমান ওয়ার্ধা জেলার প্রভারপুর (পাউনার জেলা) এবং বর্তমান নাগপুর জেলার মানসার ও নন্দীবর্ধন থেকে শাসন করেছিল। প্রভারপুর-নন্দীবর্ধন শাখাটি গুপ্ত রাজাদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। নাগপুর থেকে প্রায় 30 কিলোমিটার দূরে রামটেক পাহাড়ের কাছে প্রথম প্রবরসেনের নাতি এবং গৌতমীপুত্রের পুত্র প্রথম রুদ্রসেন (৩৪০-৩৬৫ খ্রিঃ, Rudrasena I) নন্দীবর্ধন শাখার প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি শৈব ধর্ম উপাসক ছিলেন। এরপর বাকাটক সিংহাসনে বসেন প্রথম রুদ্রসেনের পুত্র প্রথম পৃথিবীসেন (Prithvisena I)। তিনি পিতার মতই শৈব ধর্ম অনুসরণ করতেন। তিনি নন্দিবর্ধন রাজধানী স্থানান্তরিত করেন।
প্রথম পৃথিবীসেনের পুত্র দ্বিতীয় রুদ্রসেনের (Rudrasena II) সঙ্গে গুপ্ত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্ৰগুপ্ত নিজ কন্যা প্রভাবতীর বিবাহ দেন। বাকাটক ও গুপ্ত বংশের এই বৈবাহিক সম্পর্ক দুই রাষ্ট্রকেই নিরাপত্তা দেয়। বাকাটক শক্তির উপর নির্ভর করেই দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত পশ্চিম ভারতে রাজত্বকারী শক-ক্ষত্রপদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন এবং ভারত থেকে তাদের বিতাড়িত করেন। কিছুকাল পর দ্বিতীয় রুদ্রসেনের মৃত্যু হলে প্রভাবতী গুপ্ত (Prabhavatigupta) তাঁর নাবালক পুত্র দিবাকরসেনের (Divakarasena) অভিভাবিকা হিসেবে রাজ্য পরিচালনা করতে থাকেন। দিবাকরসেন সিংহাসনে আরোহণের জন্য বেশিদিন বেঁচে ছিলেন না। বড় ভাই দিবাকরসেনের মৃত্যুর পর দ্বিতীয় প্রবরসেন (Pravarasena II) স্থলাভিষিক্ত। তিনি শিবের ভক্ত ছিলেন। তিনি নন্দীবর্ধন থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন প্রভারপুর।
নরেন্দ্রসেন (Narendrasena) বাকাটক রাজ্যের সিংহাসনে বসেন। তিনি কদম্ব রাজবংশের ককুস্থবর্মনের কন্যা অজিহাতা ভট্টরিকার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বাকাটক বংশের নন্দীবর্ধন শাখার শেষ রাজা ছিলেন দ্বিতীয় পৃথিবীসেন (Prithvisena Ⅱ)। বাকাটক রাজবংশের নন্দীবর্ধন শাখার শেষ রাজা ছিলেন দ্বিতীয় পৃথিবীসেন। তিনি বিষ্ণুকুন্দিনা বংশের রাজা দ্বিতীয় মাধব বর্মার কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। 480 খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পর বাকাটকদের নন্দীবর্ধন শাখা হরিষেণ দ্বারা বৎসগুল্ম শাখার সাথে সংযুক্ত হয়েছিল।
প্রথম প্রবরসেনের দ্বিতীয় পুত্র সর্বসেন (৩৩০-৩৫৫ খ্রিঃ) বৎসগুল্ম শাখা প্রতিষ্ঠা করেন এবং বৎসগুল্ম তার রাজধানী স্থাপন করেন। রাজা সর্বসেন (Sarvasena) মহারাষ্ট্রের বর্তমান ওয়াশিম জেলায় বৎসগুল্ম শাখার করেছিলেন। বৎসগুল্ম শাখা দ্বারা শাসিত অঞ্চল ছিল সহ্যাদ্রি পর্বতমালা এবং গোদাবরী নদীর মধ্যে পর্যন্ত। সর্বসেন ‘ধর্মমহারাজ’ উপাধি গ্রহণ করেন। তাঁর পুত্র বিন্ধ্যসেন (Vindhyasena) বা দ্বিতীয় বিন্ধ্যশক্তি (Vindhyashakti) বৎসগুল্ম শাখার সিংহাসনে বসেন। তিনি কুন্তল (উত্তর কর্ণাটক) শাসনকারী বানভাসী কদম্বদের পরাজিত করেছিলেন। বিন্ধ্যসেনের পুত্র দ্বিতীয় প্রবরসেন সংক্ষিপ্ত শাসনের পর তাঁর নাবালক পুত্র দেবসেন (Devasena) স্থলাভিষিক্ত হন।
হরিষেণ (Harisena) তাঁর পিতা দেবসেনের উত্তরসূরি হন। তিনি অজন্তার কিছু বৌদ্ধ গুহার পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। অজন্তা 1983 সাল থেকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। তিনি দুটি বাকাটক শাখাকে একত্রিত করেন এবং কুন্তল, অবন্তী, কোশল, কলিঙ্গ, কোঙ্কন ও অন্ধ্র জয় করেন। হরিসেনের মৃত্যুর পর সম্ভবত কিছু শাসক স্থলাভিষিক্ত হন, তবে বাকাটক রাজবংশের শেষ অজানা। অনেকে মনে করেন, খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের মধ্যভাগে দক্ষিণ ভারতের কলচুরি শক্তির হাতে বাকাটকদের পতন হয়।
বাকাটক বংশের রাজারা গোঁড়া হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন। তাঁদের অনেকেই ছিলেন শিবের উপাসক। একমাত্র দ্বিতীয় রুদ্রসেন ছিলেন বিষ্ণুর উপাসক। তাঁরা রাজ্যে যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান করতেন, মন্দির নির্মাণ করতেন এবং ব্রাহ্মণদের ভূমিদান করতেন। বাকাটক রাজন্যবর্গ বিদ্যা ও বিধানের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। রাজা সর্বসেন ‘হরিবিজয়‘ নামে একটি প্রাকৃত কাব্য রচনা করেন। বাকাটক-রাজ দ্বিতীয় প্রবরসেন প্রাকৃত ভাষায় বেশ কিছু কাব্য রচনা করেন। এগুলির মধ্যে ‘সেতুবন্ধন‘ কাব্য উল্লেখযোগ্য। বাকাটক রাজারা স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিগোয়ার মন্দির, সেখানে সংরক্ষিত গঙ্গা-যমুনার মূর্তি এবং অজন্তার বিহার ও গুহা-চৈত্যগুলি বাকাটক যুগের শিল্পকীর্তির উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।
(FAQ) বাকাটক বংশ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য
Q1. বাকাটক রাজবংশের বিখ্যাত রাজা কে ছিলেন?
বাকাটক রাজবংশের বিখ্যাত রাজা ছিলেন প্রথম প্রবরসেন।
Q2. বাকাটক রাজবংশের বিখ্যাত রাণী কে ছিলেন?
বাকাটক রাজবংশের বিখ্যাত রাণী ছিলেন প্রভাবতী গুপ্ত।
Q3. বিন্ধ্যশক্তি কোন রাজবংশের অন্তর্গত?
বিন্ধ্যশক্তি বাকাটক রাজবংশের অন্তর্গত।
Q4. দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কন্যা প্রভাবতী কোন বাকাটক রাজাকে বিয়ে করেছিলেন?
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কন্যা প্রভাবতী গুপ্তের বিয়ে হয়েছে বাকাটক রাজা দ্বিতীয় রুদ্রসেনের সাথে।