গ্রিক জাতি অতীত গৌরবের কথা ভুলে তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের পদতলে পরাধীন জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে গ্রিক পণ্ডিত কোয়ারেস (Koares)-এর চেষ্টায় প্রাচীন গ্রিসের ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতির চর্চা আরম্ভ হয়। গ্রিক কবি বিগাস স্বদেশপ্রেম মূলক কবিতাবলীর দ্বারা গ্রিকদের সুপ্ত জাতীয় চেতনাকে জাগিয়ে তোলে। প্রাচীন গৌরবে উদ্দীপিত গ্রিক জাতি তুরস্কের অধীনতা ছিন্ন করার জন্যে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে।
গ্রিক জাতির মধ্যে ছিল এক দুর্দম শক্তি। এরা ছিল নৌ-বিদ্যা, বাণিজ্য এবং গেরিলা যুদ্ধে পারদর্শী। পাহাড় অঞ্চলের গ্রিকরা ছিল সাহসী ও যুদ্ধবাজ। সুতরাং তুরস্কের বিরুদ্ধে গ্রিসের স্বাধীনতা লাভের জন্যে সশস্ত্র সংগ্রামে এই সকল সাহসী বীর স্বতঃস্ফূর্ত যোগ দেয়।
গ্রিকরা তুর্কী সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সুবিধা ও অধিকার ভোগ করত। তুর্কী নৌ-সেনাদলে গ্রিকরা বেশীর ভাগ কাজ করত। তাঁরা অটোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যবসায়-বাণিজ্যের অধিকার ভোগ করত। তুরস্কের কাছ থেকে এই সকল সুবিধা পাওয়ার ফলে গ্রিক জাতির মনে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভের বাসনা জেগে উঠে।
ফরাসি বিপ্লবের প্রভাবে জাতীয়তাবাদী ভাবধারা বলকানে ছড়িয়ে পড়ায় গ্রিসে স্বাধীনতার আদর্শ বলবতী হয়। গ্রিসের আর্থোডক্স গীর্জা গ্রিক জাতির স্বাতন্ত্রবাদকে তীব্রতর করে। গ্রিসের পূর্বদিকে ঈজিয়ান সাগরের অসংখ্য দ্বীপে গ্রিক নৌ-বণিক ও সাহসী নৌ-যুদ্ধে দক্ষ কাপিতানি বা জাহাজ নাবিকরা বসবাস করত। যেহেতু এরা ছিল যুদ্ধবাজ শ্রেণী সেহেতু তাঁরা বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয়।
১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে জাতীয়তাবাদী গ্রিকরা ফিলকি হেটাইরিয়া (Philke Hetaria) বা গ্রিক জাতীয় ভ্রাতৃসঙ্ঘ নামে এক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে। এই সঙ্ঘের লক্ষ্য ছিল তুরস্কের হাত থেকে গ্রিসের স্বাধীনতা অর্জন করা। গ্রিসের বিভিন্ন অঞ্চলে এই সঙ্ঘের শাখা স্থাপিত করা হয়। ফলে সমগ্র গ্রিসে মুক্তি আন্দোলনের ভাবধারা ছড়িয়ে পড়ে। এই সঙ্ঘের নেতারা তুরস্কের বিরুদ্ধে জার প্রথম আলেকজান্ডারের সাহায্যে প্রার্থনা করে। জার প্রথম আলেকজান্ডার গ্রিক স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি তাঁর সমর্থন দিতে রাজী হয়।
গ্রিসের মোলদাভিয়া ও ওয়ালাচিয়া প্রদেশে আলেকজান্ডার ইপসিল্যান্টি নামক দেশপ্রেমিকের নেতৃত্বে ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি গ্রিসের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে। জার প্রথম আলেকজান্ডার মোলদাভিয়ার বিদ্রোহীদের সাহায্য করতে চাইলে অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী মেটারনিক শক্তি সমবায়ের অজুহাতে জারকে নিরস্ত করেন। বিনা বাধায় তুর্কী সেনাদল মোলদাভিয়ার বিদ্রোহ নিষ্ঠুরভাবে দমন করে। ইতিমধ্যে গ্রিসের মেরিয়া দ্বীপে গ্রিসের স্বাধীনতার যুদ্ধ (The War of Greek Independence) ছড়িয়ে পড়ে। মেরিয়া থেকে গ্রিসের প্রধান ভূখণ্ডে তুরস্কের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দাবানলের ন্যায় বিস্তৃত হয়। গ্রিক বিদ্রোহীরা বহু সংখ্যক তুর্কী সাধারণ জনগণ হত্যা করে। ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে জানুয়ারিতে গ্রিক দেশপ্রেমিকরা গ্রিসের স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য চেষ্টা চালাতে থাকে।
অটোমান সুলতান গ্রিক বিদ্রোহীদের শায়েস্তা করার জন্যে মিশরের পাশা মহম্মদ আলির সহায়তা চান। বিনিময়ে তিনি মহম্মদ আলিকে সিরিয়া ও দামাস্কাস দানের প্রতিশ্রুতি দেন। মহম্মদ আলির পাশ্চাত্য কায়দায় শিক্ষিত নৌ ও স্থল বাহিনী তাঁর পুত্র ইব্রাহিম আলির নেতৃত্বে গ্রিসে ঢুকে পড়ে। অটোমান বাহিনী মিশরীয় সেনার সাহায্যে গ্রিক বিদ্রোহীদের দমন করে।
খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী গ্রিকদের ওপর ইসলাম ধর্মাবলম্বী তুর্কীদের অত্যাচারের ফলে ইওরোপীয় জনমত গ্রিসের অনুকূলে চলে যায়। রুশ জার প্রথম নিকোলাস তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অজুহাত হিসেবে গ্রীসের স্বাধীনতাকে সমর্থন জানান। জার দানিয়ুব রাজ্য দুটি থেকে তুর্কী সেনা অপসারনের দাবী জানিয়ে চরমপত্র দেন। তুর্কী সুলতান বাধ্য হয়ে ইনকারম্যানের (Inkerman) সন্ধির দ্বারা রাজ্য দুটিতে রুশ দাবী মেনে নেন এবং সার্বিয়ার স্বাধীনতা দিতে স্বীকৃতি হয়।
ইংল্যান্ডের বিদেশ মন্ত্রী ক্যানিং বলকানে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের জন্য বিচলিত হন। ক্যানিং-এর উদ্দেশ্য ছিল বলকানে রাশিয়ার বিস্তৃতি প্রতিহত করা। এই উদ্দেশ্যে তিনি ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার সঙ্গে লন্ডনের সন্ধি স্বাক্ষর করেন। মিত্রশক্তির সম্মিলিত নৌবহর নাভারিনো উপসাগরে গিয়ে ইব্রাহিম আলিকে গ্রীস ত্যাগের জন্যে চরমপত্র দিলে, ইব্রাহিম আলি অগ্রাহ্য করেন। এর ফলে ইংরাজ নৌ সেনাপতি এ্যাডমিরাল কর্ডরিংটন ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দের ২০ অক্টোবর নাভারিনোর নৌ-যুদ্ধে তুর্কী নৌ-বহর ধ্বংস করে ফেলেন। নাভারিনোর যুদ্ধের পর ব্রিটিশ ও ফরাসী নৌ-বাহিনী গ্রীস থেকে চলে যায়। ইনকারম্যানের সন্ধি ভঙ্গের অজুহাতে রাশিয়ার সেনাদল তুরস্কের সুলতানকে ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে এ্যাড্রিয়ানোপলের সন্ধি (Treaty of Adrianople) স্বাক্ষরে বাধ্য করে। রাশিয়ার আশ্রয়াধীনে গ্রিস স্বায়ত্ব শাসন লাভ করে।
এ্যাড্রিয়ানোপলের সন্ধির দ্বারা বলকানে রাশিয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধির পেলে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়া এই সন্ধির বিরোধিতা করে। ফলে জার প্রথম নিকোলাস বাধ্য হয়ে সন্ধির শর্ত পরিবর্তন করতে রাজি হয়। ফলে ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে লন্ডন সন্ধির দ্বারা, গ্রিস একটি পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা পায়। কনস্টান্টিনোপলের চুক্তির দ্বারা অটোমান সুলতান গ্রিসের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়। ব্যাভেরিয়ার রাজপুত্র অটো গ্রীসের রাজা হিসেবে নির্বাচিত হন। গ্রিকরা প্রতি বছর ২৫ মার্চ স্বাধীনতা দিবস পালন করে।
গ্রীসের স্বাধীনতা যুদ্ধে দরুন অটোমান সাম্রাজ্যের দুর্বলতা বিশেষভাবে প্রকটিত হয়। রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবও গ্রিসের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রকাশিত হয়। এভাবে গ্রিসের স্বাধীনতা যুদ্ধে তুরস্কের দুর্বলতা, রাশিয়ার আগ্রাসন নীতি ও ইওরোপীয় শক্তিগুলির দ্বারা তার বিরোধিতা এবং বলকানে জাতীয়তাবাদী স্ফূরণ প্রভৃতি পূর্বাঞ্চল সমস্যার সকল দিকগুলি প্রকট হয়। তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের ভাঙন গ্রিসের স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে সূচিত হয়।