দীর্ঘ সংগ্রামের পর প্রায় দুশো বছর পরে পরাধীন ভারতের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়। ভারত স্বাধীন হলেও কিন্তু দ্বিধাবিভক্ত হয়। জন্ম নেয় নতুন শিশুরাষ্ট্র পাকিস্তান। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের প্রতীক ভারতের অঙ্গচ্ছেদ ঘটে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায় ভারত বিভাগ কি অনিবার্য ছিল? (Was the partition of India inevitable)
জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দের ভূমিকা: ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দের ভুলভ্রান্তি এবং তাদের কয়েকজনের ক্ষমতালাভের অদম্য আকাঙ্ক্ষা ও জেদি মনোভাব ভারত বিভাগ অনিবার্য করে তোলে। দেশের আপামর সাধারণ মানুষ কিন্তু দেশভাগের পরিণতির জন্য আদৌ তৈরি ছিল না। হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভিন্নক্ষেত্রে অমিল থাকলেও দেশ বিভাগের মতো ভয়ংকর পরিণতি তাদের কাম্য ছিল না। জাতীয় কংগ্রেসের ক্ষমতালোভী নেতৃবৃন্দ ভারত বিভাগের মধ্যেই সমস্ত সমস্যার সমাধান দেখতে পেয়েছিলেন।
মুসলিম লিগের ভূমিকা: ভারত বিভাগের জন্য হিন্দু-মুসলমান দ্বি-জাতি তত্ত্বের প্রবক্তা জিন্নাকে দায়ী করা হয়। কলকাতার দাঙ্গা ও দেশের সর্বত্র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রমাণ করেছিল, একত্রে হিন্দু-মুসলমানদের সহাবস্থান সম্ভব নয়। জিন্না মুসলিম লিগের নেতৃত্ব গ্রহণের পর উপলব্ধি করেছিলেন, ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ভারতের জাতীয় আন্দোলনে প্রাধান্য পেয়ে আসছে, তাই তিনি মুসলিম লিগকে জাতীয় কংগ্রেসের সমপর্যায়ভুক্ত করতে উদ্যোগী হন। যা শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান আন্দোলনকে জোরদার করে এবং ভারত বিভাগ অবশ্যম্ভাবী করে তোলার পথকে প্রশস্ত করে।
ধর্মীয় প্রভাব: কংগ্রেস একটি হিন্দু প্রতিষ্ঠান—এই আখ্যা দিয়ে জিন্না মুসলিম লিগকে মুসলমানদের প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠী মনে করেছিলেন, কংগ্রেস প্রায় সকল স্বার্থ ও মতকে আপন জাতীয়তাবাদী ছত্রছায়ায় আনতে সক্ষম হলেও মুসলমানদের টানতে ব্যর্থ হয়েছিল। তাই দেশবিভাগ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। তবে গান্ধিজি যে রামরাজ্যের আদর্শ প্রচার করেছিলেন, সেখানে ধর্মীয় সংকীর্ণতা ছিল না। হিন্দু মহাসভা, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ প্রভৃতি হিন্দু সাম্প্রদায়িক দল ও গোষ্ঠীগুলি হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বিভেদকে তীব্র করে তুলেছিল।
ব্রিটিশ সরকারের বিভেদ নীতি: ভারত বিভাগের পশ্চাতে ব্রিটিশ সরকারের বিভেদনীতি (Divide and Rule) পরোক্ষে ভাবে দায়ী ছিল। হিন্দু-মুসলমান নেতারা যদি ব্রিটিশ সরকারের বিভেদ নীতি বুঝতে সক্ষম হতেন তাহলে হয়তো ভারত বিভাগ এড়ানো যেত। ব্রিটিশ সরকারের লক্ষ্য ছিল ঔপনিবেশিক শাসন বজায় রাখার জন্য সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করা। তাই ব্রিটিশ সরকার সংখ্যালঘু মুসলমানদের মধ্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষার বীজ বপন করেছিল। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল, রাজা ষষ্ঠ জর্জের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, ভারতে ঔপনিবেশিক শাসন টিকিয়ে রাখতে হলে এবং ব্রিটিশের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করতে হলে পাকিস্তান গঠন করা আবশ্যিক। তবে একথা বলা যায়—হিন্দু-মুসলমান বিভেদ সৃষ্টিতে সরকারের যতটা দায়িত্ব ছিল, তার থেকে বেশি দায়িত্ব ছিল হিন্দু ও মুসলমান নেতাদের।
সংগঠন হিসাবে কংগ্রেসের ভূমিকা: সমকালীন সময়ে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস জাতীয় আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। জাতীয় কংগ্রেস কখনই চায়নি ভারত বিভাগকে। কিন্তু কতকগুলি পরিস্থিতি জাতীয় কংগ্রেসকেও বাধ্য করেছিল। ভারত বিভাগকে তাদের অস্তিত্ব ও ক্ষমতা রক্ষার পথ হিসাবে মেনে নিতে। মুসলিম লিগের এক জেদি মনোভাব অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অসহায়তা প্রমাণ করেছিল। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে সারা দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, গণহত্যা দেশবিভাগের পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। বিভিন্ন প্রদেশে কংগ্রেসের ভাঙন পাকিস্তান দাবিকে ইন্ধন জোগায়।
মূল্যায়ন: ভারত বিভাগের জন্য প্রত্যক্ষভাবে জাতীয় কংগ্রেস, মুসলিম লিগ বা জিন্না ও ব্রিটিশ সরকার পুরোপুরি দায়ী না হলেও প্রত্যেকের কিছু কিছু দায়িত্ব ছিল। কেউই প্রথমে পৃথক রাষ্ট্র গঠন চাননি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রত্যেকের কাছেই ভারত বিভাগকে সব সমস্যার সমাধানের পথ বলে মনে হয়। সবশেষে বলা যেতে পারে, ভারত বিভাজন যাদের স্বার্থরক্ষার তাগিদে করা হয়েছিল তারা কেউই কোনোভাবেই লাভবান হননি।