বর্তমান পৃথিবীতে রাজতন্ত্রের অস্তিত্ব প্রায় লক্ষ্য করা যায় না। ব্রিটেনে প্রথম শিল্প বিপ্লব শুরু হয়। এই শিল্প বিপ্লবের ফলে নতুন নতুন কলকারখানা গড়ে ওঠে এবং বুর্জোয়া ও সর্বহারার সুস্পষ্ট শ্রেণীভেদ লক্ষ্য করা যায়। মার্কসবাদী দৃষ্টিতে বিচার করলে শ্রেণী সংগ্রাম, বিপ্লব এবং সমাজতন্ত্রের অভ্যুদয় ইংল্যান্ডের মাটিতেই হওয়ার কথা। কিন্তু রাজতন্ত্রকে সরিয়ে ইংল্যান্ডে সমাজতন্ত্রের আবির্ভাব ঘটেনি। সুতরাং ইংল্যান্ডে রাজতন্ত্র টিকে থাকার বিষয়টি আলোচনার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। ইংল্যান্ডে রাজতন্ত্র টিকে থাকার কারণ হিসাবে আইভর জেনিংস তাঁর “The Queen’s Government” নামক গ্রন্থে চারটি যুক্তি দেখিয়েছেন—(১) রাজা/রানী সংবিধানকে ধারণ করে আছেন, (২) তাঁকে ঘিরে কমনওয়েলথের ঐক্য বজায় রয়েছে, (৩) তিনি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রনৈতিক দায়িত্ব পালন করেন; এবং (৪) সামাজিক জীবনে তাঁর দায়িত্ব সমধিক। আইভর জেনিংসের মত ও অন্যান্য যুক্তির সাহায্যে রাজতন্ত্র টিকে থাকার কারণগুলি নিম্নলিখিতভাবে আলোচনা করা যায়।
(১) ইংরেজ জাতির রক্ষণশীল প্রকৃতিঃ ইংরেজ জাতির রক্ষণশীল প্রকৃতি রাজতন্ত্রের মত প্রাচীন ও ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রেখেছে। রক্ষণশীলতার জন্যই রাজতন্ত্রকে তাঁরা সুদূর অতীত থেকে রক্ষা করে আসছে, তাকে বলিষ্ঠ যুক্তি ব্যতীত পরিত্যাগ করার প্রয়োজন অনুভব করে নি। অ্যাংলো-স্যাক্সন যুগ থেকে আজ পর্যন্ত রাজা ও রানী সাধারণ মানুষের নিকট শ্রদ্ধা ও সম্মান পেয়ে আসছেন। রাজার প্রতি আনুগত্য ও শ্রদ্ধা সাধারণ মানুষকে সরকারের প্রতি নাগরিক হিসাবে বিশেষ কর্তব্য পালনে প্রেরণা দেয়।
(২) গণতন্ত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করেছে: গণতন্ত্রের প্রসারের পথে রাজতন্ত্র কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতার সৃষ্টি করে নি। গৌরবময় বিপ্লবের পরবর্তী অধ্যায় থেকেই রাজতন্ত্র পরিবর্তনশীল অবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেছে। তা সম্ভব না হলে রাজতন্ত্র বাঁচত না। জনসাধারণ রাজাকে নিরপেক্ষ বলে মনে করে; তিনি সকল দলাদলির ঊর্ধ্বে। রাজা রাজত্ব করেন কিন্তু শাসন করেন না।
(৩) ব্যয়ও অল্প হয়: পার্লামেন্টারী শাসনব্যবস্থায় একজন নিয়মতান্ত্রিক শাসকের প্রয়োজন আছে। সুতরাং রাজা বা রানীর পরিবর্তন করতে চাইলে অন্য একজন শাসনতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধানের পদের প্রবর্তন করতে হবে। কিন্তু ফ্রান্স অথবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির পদ প্রবর্তনের পরিবর্তে রাজপদ প্রবর্তনই ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থায় অধিক সুবিধাজনক মনে হয়েছে। সীমাবদ্ধ রাজতন্ত্র বা নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র জনগণের মনে স্থায়ী আসন লাভ করেছে।
(৪) রাজপদ বিলুপ্তিতে আর্থিক সুবিধা লাভ সম্ভব নয়: রাজপদ বিলুপ্ত করে বিশেষ কোন আর্থিক সুবিধা হবে বলে কেউ মনে করেন না। ইংল্যান্ডের রাজা বা রানীর জন্য রাজকোষ থেকে যে অর্থ ব্যয় করা হয়, তা রাজপদের উপযোগিতার তুলনায় বেশি নয়।
(৫) পরামর্শদানের মূল্যবান ভূমিকা: রাজা বা রানীর পরামর্শ দানের যে ভূমিকা আছে, তাও কম মূল্যবান নয়। দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থায় নীতি নির্ধারণ ও শাসন পরিচালনায় চূড়ান্ত ক্ষমতা মন্ত্রীদের ওপর ন্যস্ত। কিন্তু রাজা বা রানীর পরামর্শ দানের, উৎসাহ দানের এবং সতর্ক করবার ক্ষমতা নিঃসন্দেহে শাসনকার্য পরিচালনায় সহায়তা করে থাকে। বার্কার বলেন, আজীবন পদে অধিষ্ঠিত থাকবার ফলে রাজা বা রানীই শাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের মূল উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
(৬) সামাজিক পদমর্যাদা ও প্রভাব: ইংল্যান্ডের সামাজিক রীতিনীতি ও আচার-ব্যবহারের ক্ষেত্রে রাজপরিবারের বিশেষ প্রভাব রয়েছে। সাহিত্য, শিল্প, নৈতিকতা এবং শাসনের ক্ষেত্রে রাজপরিবারের উদাহরণ জনগণ আগ্রহের সঙ্গে গ্রহণ করে থাকে।
(৭) রাজা দেশাত্মবোধের প্রতীক: ইংল্যান্ডের জাতীয় জীবনের যথার্থ প্রতিনিধি হিসাবে রাজপদ স্বীকৃত হয়েছে। রাজা কোন দলের বা শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করেন না। জাতির প্রধান হিসাবে তিনি জনগণের আনুগত্য লাভ করেন এবং তাদের মনে গভীর দেশপ্রেম সঞ্চার করেন। সুতরাং রাজা বা রানীকে দেশাত্মবোধের প্রতীক বলে গণ্য করা হয়।
(৮) রাজা ঐক্যের প্রতীক: ইংল্যান্ডের জনমনে রাজা বা রানী সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করবার প্রতীক হিসাবেই গণ্য হন। জনগণের নিকট রাজা বা রানী হলেন ঐতিহ্যের ধারক, তাদের ভবিষ্যৎ ও আশা- আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্র, ঐক্যের প্রতীক এবং সর্বজনীন প্রতিনিধি।
(৯) ব্রিটিশ কমনওয়েলথের বন্ধনসূত্র: ব্রিটিশ কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলির মধ্যে বন্ধনসূত্র এবং সাম্রাজ্যের ঐক্যের প্রতীক হিসাবে রাজা বা রানীর গুরুত্ব আছে। তাঁর অবর্তমানে কমনওয়েলথের ঐক্য বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কার্যত যদিও ডোমিনিয়নগুলি সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করে থাকে, তবুও সকল বিভেদ সত্ত্বেও রাজা বা রানীকে তাঁরা কমনওয়েলথের প্রধান হিসাবে স্বীকার করেছে।
(১০) রাজশক্তিকে জনগণের স্বীকৃত সত্য বলে স্বীকার: ব্রিটেনের সাধারণ মানুষ প্রাকৃতিক আবহাওয়াকে যেমন স্বীকৃত সত্য বলে গ্রহণ করেছে, আপাত অসামঞ্জস্য সত্ত্বেও রাজশক্তিকেও সেরূপভাবে স্বীকার করে নিয়েছে। শাসকশ্রেণীও নিজ স্বার্থে রাজশক্তিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। সমাজজীবনে বিপ্লবাত্মক পরিবর্তনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য রাজার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির চেষ্টা হয়েছে। ব্রিটেনের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই জাতীয় জীবনের প্রতিনিধিমূলক সংস্থা হিসাবে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র স্বীকার করে নিয়েছে। শ্রমিক দল ক্ষমতা লাভ করে অনেক সময় লর্ডসভার বিলোপের জন্য মুখর হলেও রাজতন্ত্রের অবসান কখনও চিন্তা করেনি। সুতরাং রাজতন্ত্র আজও টিকে থাকবার পিছনে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী শাসকগণ নিজেদের স্বার্থেই রাজতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রেখেছে এবং বিভিন্ন প্রচারের মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করে রাজতন্ত্র সম্পর্কে মোহ বিস্তার করতে সমর্থ হয়েছে। রাজতন্ত্র ব্যাপক পরিবর্তনের বাধাস্বরূপ, তাই ইংল্যান্ডের পুঁজিপতি শ্রেণী স্থিতাবস্থা সংরক্ষণের জন্যেই রাজতন্ত্রকে অপরিহার্য বলে গ্রহণ করেছে।