কোন ব্যক্তি-শিশুকে জন্মাবস্থায় সামাজিক বা অসামাজিক বলা না গেলেও তাকে যে একটি সজীব সত্তা হিসেবে বিবেচনা করা যায় তা বলাই বাহুল্য। এই সজীব সত্তা হিসেবে ব্যক্তি-শিক্ষার্থী তার পরিবেশের সাথে অভিযোজন করতে শেখে এবং ধীরে ধীরে ক্রমবিকাশের পথে বিভিন্ন সামাজিক গুণাবলি আয়ত্ত করে পর্যায়ক্রমে সামাজিক বিকাশকে ত্বরান্বিত করে। এখানে যে শিক্ষার সমাজতত্ত্বমূলক ভিত্তি মূর্ত হয়ে ওঠে তা বলাই বাহুল্য।
বস্তুত সামাজিক জীব হিসেবে ব্যক্তি মানুষকে সমাজের মধ্যে থেকে তাঁর সহজাত প্রবৃত্তি, প্রবণতা ও স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যসমূহকে পূর্ণ পরিণতির পথে বিকশিত করতে হয়। এজন্য সমাজের মধ্যে থেকে মানুষকে সমাজস্থ বিভিন্ন ব্যক্তির পারস্পরিক সম্বন্ধের মাধ্যমে শিক্ষামূলক, কৃষ্টিমূলক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয়ে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের আঙিনায় সমাজ পরিবেশের সঙ্গে সংগতিসাধন করার যোগ্যতা অর্জন করতে হয় এবং নিজের সামাজিক বিকাশকে বাস্তবায়িত করতে হয়।
বস্তুত প্রতিটি ব্যক্তিকে অন্য ব্যক্তির সাথে ও সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে সুষ্ঠু অভিযোজন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজের সামাজিক বিকাশকে পরিচালনা করার যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। প্রসঙ্গত, বলা দরকার যে ব্যক্তির সামাজিক বিকাশের বৈশিষ্ট্যসমূহ ব্যক্তির জন্মমুহূর্ত থেকেই প্রকাশিত হয় না। ব্যক্তি-শিশু ধীরে ধীরে পূর্ণ পরিণতির দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় তার চারপাশের নানান মানুষের ও পরিবেশের সংস্পর্শে আসে এবং কালক্রমে ছোট বড় বহুবিধ প্রতিষ্ঠানে ও সংঘে সক্রিয় অংশ নিয়ে নিজের সমাজ চেতনা বিকাশের সুযোগ পায়।
তাই শিক্ষার্থী-শিশুর মধ্যে সামাজিক আচরণের যে সকল ক্ষমতা লুপ্ত থাকে কালের গতিতে তা উপযুক্ত পরিবেশের সঙ্গে সংগতিসাধনের পথ খুঁজে পেতে সহায়তা করে এবং নিজস্ব সমাজ চেতনার বিকাশকে বাস্তব রূপ দিতে প্রণোদিত করে। এখানে সমাজতত্ত্বমূলক তত্ত্বের ও তথ্যের ভিত্তি অবশ্যই কার্যকরী ভূমিকা নেয়।
উপরোক্ত প্রেক্ষিতে বলা যায় যে সামাজিক আচরণের উপযোগী কতগুলি সংলক্ষণ (Traits)—যথা পারস্পরিক সহযোগিতা, সহানুভূতি, দয়া-মায়া, যূথবদ্ধতা প্রবৃত্তির প্রভাবে সংঘবদ্ধভাবে কাজ করার প্রবণতা, পারস্পরিক নির্ভরতা বোধ প্রভৃতি ব্যক্তি-শিশুর মানসিক সংগঠনের মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় থাকে এবং উপযুক্ত পরিবেশের মধ্যে সেগুলির অভিব্যক্তি ঘটে।
এর থেকে এটুকু পরিষ্কার যে শিক্ষার্থী-শিশু সমাজের রীতিনীতি, আদর্শ, ভাবধারা, আচরণ, ছাঁদ প্রভৃতি যে পরিমাণে আয়ত্ত করতে পারে তার উপরই ব্যক্তি-শিশুর সামাজিক বিকাশ নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। এজন্য সমাজ-বহির্ভূত জীব কখনই সামাজিক আচরণ শেখে না এবং তার সামাজিকীকরণও অসম্ভব হয়ে ওঠে। এ দিক থেকে শিশুর সামাজিকীকরণ ও সামাজিকীভবন মূলত এক ধরনের শিখন প্রক্রিয়া—কতগুলি সামাজিক অভ্যাস গঠনের প্রচেষ্টা।
প্রাথমিকভাবে মানুষ অহং ভাবাপন্ন (egoist) এক আত্মকেন্দ্রিক জীব। একমাত্র সামাজিকীকরণের ফলেই তার মধ্যে সমাজচেতনা প্রকাশ পায়। তাছাড়া শিক্ষার লক্ষ্য হিসেবে শিক্ষার্থীর সামাজিক বিকাশের ধারা যেমন তার আত্মকেন্দ্রিকতা দূর করে, সামাজিকীকরণ সম্ভব করে তোলে—তেমনি শিক্ষার উদ্দেশ্য সামাজিক কৃষ্টি-সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও উন্নতি সাধনকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়।
শুধু এটাই নয়, সমাজের গতিধর্মিতা বজায় রাখতে শিক্ষার লক্ষ্য হচ্ছে এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মে সামাজিক কৃষ্টির সঞ্চালনের (Transmission of cultural heritage) ব্যবস্থা নেওয়া এবং সমাজের সকল বিচ্ছিন্নতাকে প্রতিরোধ করে সমাজ সংহতি, সমন্বয় ও প্রগতিকে (social integration, cohesion and progress) মূর্ত করে তোলা।
এদিক থেকে সমাজ কল্যাণের স্বার্থে শিক্ষার লক্ষ্য হচ্ছে প্রতিটি শিক্ষার্থী-শিশুকে ভবিষ্যতে সুনাগরিক হিসেবে প্রস্তুত করা এবং প্রত্যেককে বৃহত্তর সামাজিক স্বার্থে ব্যক্তি-স্বার্থকে বিসর্জন দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করা। তাই শিক্ষার মহান লক্ষ্য হচ্ছে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে সমাজের দায়িত্ব, কর্তব্য, রীতিনীতি সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া, সমাজের দুর্নীতি প্রতিরোধ করা এবং সকল বিচ্ছিন্নতা দূর করে সমাজে সংহতি স্থাপনে উদ্যোগ নিতে সহায়তা করা।
তবে বলাই বাহুল্য যে, শিশুর সামাজিকীকরণের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রীকরণের প্রক্রিয়াও চলতে থাকে এবং ফলত সমাজচেতনা সংগঠনের পাশাপাশি শিশুর ব্যক্তিত্ব সংগঠনও সম্ভব হয়ে ওঠে। শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্ব সংগঠনের এই প্রক্রিয়ায় সমাজতত্ত্বমূলক ভিত্তিকে অবশ্যই মূল্যবান মনে করতে হয়। এজন্য শিক্ষার লক্ষ্যে সামাজিক সমৃদ্ধি সংগঠনের বিষয়টি এত বেশি গুরুত্ব পায় এবং সমাজতত্ত্বের তথ্য ও তত্ত্বের বিভিন্ন বিষয়কে স্বীকৃতি দিতে হয়।
সুতরাং পরিশেষে বলা যায় যে শিক্ষার একটি লক্ষ্য যেমন প্রতিটি শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্বের সর্বাঙ্গীণ, স্বাভাবিক, সুষম ও সর্বোত্তম বিকাশ সাধনকে বাস্তবায়িত করা তেমনি প্রতিটি শিক্ষার্থীকে সমাজের কৃষ্টি-সংস্কৃতির সাথে পরিচিত করে তাকে সমাজ জীবনের উপযোগী করে তোলাও শিক্ষার অপর একটি অন্যতম লক্ষ্য।