বিজয়নগর রাজ্যের সামরিক ব্যবস্থা ও ভূমিদান রীতির সাথে বিশেষ ভাবে জড়িত ছিল ‘নায়ঙ্কারা’ বা ‘নায়ক’ বা ‘নয়নকারা’ প্রথা। ষোড়শ শতকে পর্তুগীজরা বিজয়নগরের ‘নায়ক’ উপাধিধারীদের ‘ক্যাপ্টেন’ বলে অভিহিত করত। অধ্যাপক অনিরুদ্ধ রায়ের মতে, বিজয়নগরে নায়করা স্থানীয় নেতৃবর্গের থেকে স্বাধীন। ফলে অনেক মানুষ ‘নায়ঙ্কারা’ রাজনৈতিক কাঠামোর অন্তর্ভূক্ত হয়ে যেত। বিজয়নগরের বিভিন্ন শিলালেখতে ‘অমরয়ঙ্কর’ শব্দটি পাওয় যায়। এখানে ‘অমর’ অর্থে সৈন্যাধ্যক্ষ, ‘নায়ক’ অর্থে নেতা এবং ‘কর’ বলতে সরকারি কাজকে বোঝান হয়েছে।
পণ্ডিত নীলকণ্ঠ শাস্ত্রীর মতে, ১৫৬৫ সাল পর্যন্ত নায়করা বিজয়নগর রাজার ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল ছিলেন। পরে তাঁরা আধা-স্বাধীন হয়ে যায়। ১৯৫৫ সালে তিনি বলেন যে, নায়করা মূলত ছিল সামন্ত এবং তাঁরা রাজাকে সামরিক সাহায্য দানের শর্তে ভূমির অধিকার ভোগ করতেন। ১৯৬৪ সালে তিনি পুনরায় বলেন যে, বিজয়নগর একটি ‘যোদ্ধা-রাজ্য’ বা war-state এবং সামরিক প্রয়োজন অনুসারে গড়ে উঠেছে। তাঁর মতে বিজয়নগর সাম্রাজ্য ছিল অসংখ্য সামরিক নেতার মিলিত প্রয়াসের ফল।
বিজয়নগরের ‘নায়ঙ্কারা’ প্রথা কৃষির উপর প্রভাব ফেলেছিল। প্রধানত, জমির উপর নিয়ন্ত্রনের চরিত্র থেকে সাধারণ কৃষক, রাজা ও সামরিক নায়কদের ক্ষমতার ভিত্তি ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বা কর্তৃত্বের সম্পর্ক বিকশিত হয়। পণ্ডিত নীলকণ্ঠ শাস্ত্রীর মতে, চোল আমলে জনপ্রিয় ‘সভা’, ‘উর’ বা ‘নাডু’ ইত্যাদির আস্তিত্ব বিজয়নগরের আমলে শিথিল হতে থাকে এবং কালক্রমে প্রায় বিলোপ ঘটে। পণ্ডিত কৃষ্ণস্বামীর মতে, বিজয়নগর রাষ্ট্রের সামরিক সংস্থা ও সামন্ততান্ত্রিক পদ্ধতি থেকে উদ্ভূত অবহেলার ফলে পূর্বেকার স্থানীয় সংগঠনগুলি অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। তাঁর মতে, নায়ঙ্কারা প্রথার মাধ্যমে গ্রামীণ কর্মচারীদের জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হত। অধ্যাপক অনিরুদ্ধ রায়ের মতে, ‘নাত্তার’ নামক গ্রামীণ কর্মচারী পদের বিলোপ এবং ‘নায়ঙ্কারা’ পদের উত্থান স্থানীয় পরিবর্তন হিসেবে আবির্ভূত হয়। এইভাবে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের আমলে প্রচলিত দক্ষিণ ভারতীয় রীতি এবং গোষ্ঠী, নেতা ও গ্রামের মধ্যে সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটে। এর পরিণামে ভূমি ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে যায়।
অধ্যাপক রায়-এর মতে, বিজয়নগরের ‘নায়ঙ্কারা’ প্রথাকে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে একীভূত করা সঠিক নয়। কেবল সামরিক সাহায্যের বিনিময়ে জমি ভোগ করার অধিকার থাকলে নায়ঙ্করা প্রথাকে সামন্ততান্ত্রিক প্রথার কাছাকাছি বলা যেত। কিন্তু বিজয়নগরের ‘নায়ক’ এমন একজন যোদ্ধা যে রাজ্যের সামরিক ব্যবস্থার অন্যতম অঙ্গ এবং যে সবসময় তার নিজের অধিকারে একজন জমিদার স্থানীয়। পর্যটক নুনিজ প্রায় ২০০ জন নায়কের সন্ধান পেয়েছেন এবং তিনি এমন কোন ইঙ্গিত দেননি যে বিজয়নগর বিকেন্দ্রীভূত প্রশাসনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিল।
বার্টন স্টাইন ‘কেম্ব্রিজ ইকনমিক হিস্ট্রি অব ইণ্ডিয়া’ গ্রন্থে (১৯৮২ খ্রীঃ) প্রকাশিত প্রবন্ধে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীক চরিত্র ও ভূমিব্যবস্থা সম্পর্কে নতুন মূল্যায়ন করেছেন। তাঁর মতে, মধ্যযুগীয় দক্ষিণ ভারতের রাজনীতি অনুসারে বিজয়নগর রাজ্যও ছিল একাধিক অংশের সমন্বয় বিজয়নগরকে একটি বৃহত্তর এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করলেও, বিজয়নগরের রাজা কার্যত একটি ছোট্ট এলাকাকে প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন। রাজ্যের অবশিষ্ট অংশের আঞ্চলিক শাসকরা (নায়ক) রাজার প্রতি আনুগত্য দেখালেও প্রায় স্বাধীনভাবে শাসন পরিচালনা করতেন। এই খণ্ডিত অংশগুলি সম্মিলিতভাবে বিজয়নগরের সামগ্রিক রাজ্য সৃষ্টি করে ছিলেন। স্টাইনের মতে, বিজয়নগরের শাসন ব্যবস্থায় বিকেন্দ্রীকরণ প্রবণতার বিকাশ ঘটে। স্থানীয় সামরিক নেতা বা নায়কেরা ছিলেন আঞ্চলিক সর্বেসর্বা। তাঁরা স্থানীয় রাজস্ব আদায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ভারপ্রাপ্ত ছিলেন। নায়ক দুর্গ নির্মাণ করে নিজের ক্ষমতা ও অধিকার সুরক্ষিত রাখতেন এবং সামরিক শক্তির সংরক্ষক হিসেবে রাজাকে তাদের উপর নির্ভরশীল থাকতে বাধ্য করতেন।
নায়কদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি প্রসঙ্গে বিজয়নগরের ভূমি ব্যবস্থা লক্ষণীয় ছিল। বিজয়নগরে তিন ধরনের এলাকা ছিল— ‘অমরা’, ‘ভণ্ডারভড়া’ এবং ‘মান্য’। সব থেকে ছোট এলাকা ছিল ভণ্ডারভড়া বা সরকারি গ্রাম। এর আয়ের কিছু অংশ দুর্গের রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় করা হত। কিছু আয় মঠ, মন্দির ইত্যাদিকে দান করা হত। মান্য ছিল নিষ্কর গ্রাম যা দেবস্থান বা ব্রাহ্মণদের দান করা হত। অবশিষ্ট সকল অঞ্চল ছিল ‘অমরা’র অন্তর্ভুক্ত। এই সকল গ্রাম বিজয়নগরের রাজারা ‘অমরানায়ক’-দের অর্পণ করেছিলেন। ফলে নায়কদের হাতে অর্থ ও শক্তি কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। স্টাইনের মতে, অমরানায়করা এইভাবে বিজয়নগর অর্থনীতির সিংহভাগ দখল করেছিলেন এবং কার্যত তাঁরাই ছিলেন রাজার সম্পদ সংগ্রহের প্রধান মাধ্যম। সামরিক ও আর্থিক ক্ষমতার অধিকারী এই সকল নায়কের কর্তৃত্ব অস্বীকার করা রাজার পক্ষে অসম্ভব ছিল। স্টাইনের মতে, নায়কদের হাতে জমির কেন্দ্রীকরণ ঘটলেও, বিজয়নগরের ব্যবস্থাকে ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রের সমতুল্য বলা চলে না। বিজয়নগরের পঁচাত্তর শতাংশ জমি বিভিন্ন নায়কদের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে ছিল। এই ব্যবস্থা জাপানের সামন্ততন্ত্রের কিছুটা কাছাকাছি। তবে এক্ষেত্রেও স্পষ্ট প্রভেদ লক্ষণীয়। বিজয়নগরে নায়করা প্রত্যক্ষভাবে জমি নিয়ন্ত্রণ করতেন এবং এখানে কোন স্বীকৃত মধ্যবর্তীর অস্তিত্ব ছিল না। এই বিচারে বিজয়নগরকে একটি ‘যোদ্ধা-রাষ্ট্র’ (war-state) বলা সংগত, সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়।