সুলতানি যুগের শেষ দিকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে একাধিক স্বাধীন রাজ্যের উদ্ভব হয়—এগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল দাক্ষিণাত্যের বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্য। বিজয়নগর রাজ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে কৃতিত্বের অধিকারী ছিলেন তুলুভ বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ নরপতি কৃষ্ণদেব রায়। পর্তুগিজ পর্যটক পায়েজ তাঁর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেছেন যে, “রাজাদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সর্বাপেক্ষা পন্ডিত এবং সর্বোত্তম শাসক, সুবিচারক, সাহসী ও সর্বগুণান্বিত।”
(১) সামরিক কার্যকলাপ: কৃষ্ণদেব রায়ের কার্যকলাপ ছিল বহুমুখী। তিনি ছিলেন একাধারে সুদক্ষ যোদ্ধা ও সুদক্ষ শাসক। তিনি ১৫১২ খ্রীষ্টাব্দে বিজাপুরের সুলতানকে পরাজিত ও নিহত করে রায়চুর দোয়াব দখল করে নেন। তিনি ‘গুলবর্গা দুর্গ’ দখল করতে সক্ষম হন এবং ‘বিদর’ আক্রমণ করে ‘বারিদ’ দুর্গটি হস্তগত করেন। এরপর কৃষ্ণদেব রায় মামুদ শাহকে বাহমনী রাজ্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। এই কাজকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য কৃষ্ণদেব রায় ‘যবন রাজ্যস্থাপন আচার্য’ উপাধি গ্রহণ করেন। কৃষ্ণদেব রায় দক্ষিণ-মহীশূরের বিদ্রোহী শাসক পলিগারদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে শ্রীরঙ্গপত্তম ও শিবনসমুদ্রম দখল করেন।
তিনি উড়িষ্যার অধিপতি গজপতি প্রতাপরুদ্র-কে পরাজিত করে উদয়গিরি (১৫১৩ খ্রী:) ও কোণ্ডাভিডু (১৫১৪ খ্রী:) পুনরুদ্ধার করেন। ১৫২০ খ্রীষ্টাব্দে বিজাপুরের সুলতান ইসমাইল আদিল শাহ রায়চুর দোয়াব পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করলে, তিনি কৃষ্ণদেব রায়ের কাছে পরাজিত হন। তাঁর সাম্রাজ্য উত্তরে উড়িষ্যা, পশ্চিমে কোঙ্কন, পূর্বে বিশাখাপত্তনম এবং দক্ষিণে সমুদ্রোপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
এদিকে কৃষ্ণদেব রায়ের সময় ইউরোপীয় পর্তুগীজরা শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু কৃষ্ণদেব রায় পর্তুগীজদের সঙ্গে কোনরকম সংঘর্ষে লিপ্ত হননি, উপরন্তু তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থান রক্ষা করে চলতেন। পর্তুগীজরা তাঁর কাছে একটি ঘাঁটি গড়ার সম্মতি পায়।
(২) সাংগঠনিক পদক্ষেপ: কৃষ্ণদেব রায় অপরাজেয় যোদ্ধা রূপেই নয়, সুশাসক ও সংগঠকরূপেও যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দেন। তিনি দক্ষ প্রশাসক ছিলেন। তাঁর শাসনে বিজয়নগরে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি বিরাজ করত। পর্তুগীজ পর্যটক ও বণিক পায়েজ, নুনিজ, বারবোসার বিবরণ থেকে জানা যায় যে, তিনি ছিলেন উদারচেতা, অতিথি পরায়ণ, পরধর্মসহিষ্ণু শাসক। প্রজাদের মঙ্গল সাধনের জন্য তিনি আগ্রহী ছিলেন। তিনি বছরে অন্তত একবার সারা রাজ্য পরিভ্রমণ করে ব্যক্তিগতভাবে প্রজাদের অভাব-অভিযোগ শুনতেন এবং তার প্রতিকারের ব্যবস্থা করতেন। তিনি বিজয়নগরের কাছে একটি নতুন শহর নির্মাণ করান। এছাড়া সেচকাজের জন্য একটি বিশাল জলাধার খনন করা হয়। তিনি প্রজাদের উপর থেকে বিবাহ-কর তুলে দেন। কৃষিজমি বৃদ্ধির জন্য তাঁর নির্দেশে বহু জঙ্গল কেটে সেখানে চাষযোগ্য জমি তৈরী করা হয়েছিল।
(৩) শিল্প-সাংস্কৃতিক কৃতিত্ব: সংস্কৃতিবান ও সুপণ্ডিতরূপে কৃষ্ণদেব রায় অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয় দেন। তিনি শিল্প, সাহিত্য, সংগীত ও বিদ্বজ্জনের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি নিজে ছিলেন তেলেগু ও সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত। তাঁর রাজত্বকালে তেলেগু ভাষার নবযুগের সূচনা হয়েছিল। তেলেগু ভাষায় কৃষ্ণদেব রায় রচিত রাজনীতি বিষয়ক গ্রন্থ ‘আমুক্ত মাল্যদা’ ও সংস্কৃত ভাষায় রচিত নাটক ‘জাম্ববতি কল্যাণম’। এছাড়া পেড্ডান রচিত ‘মনুচরিতম্’, নন্দী তিমায়া’র রচিত ‘পারিজাত পহরনামু’ প্রভৃতি তেলেগু ভাষায় সাহিত্যচর্চার প্রধানতম ফসলরূপে স্বীকৃতি পেয়েছে। তিনি তেলেগু, কানাড়া, তামিল কবিদের সমানভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। অনেকের মতে, তাঁর রাজসভা আটজন বিশেষ পণ্ডিত অলঙ্কৃত করেছেন—এরা ‘অষ্ট দিগগজ’ নামে পরিচিত।
কৃষ্ণদেব রায় একজন মহান নির্মাতা ছিলেন। তিনি বহু মন্দির, গোপুরম ও মণ্ডপ দ্বারা বিজয়নগরকে সুসজ্জিত করেন। কৃষ্ণস্বামী মন্দির, ভিটলস্বামী মন্দির এবং হাজারা রামস্বামী মন্দির তাঁর আমলের উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য-কীর্তি। তিনি নেগল্লপুর নগর প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিজয়নগরের কাছে জলসেচের জন্য একটি বিরাট হ্রদ খনন করেন। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে বিষ্ণর উপাসক হলেও সকল ধর্মের প্রতি সহনশীল ছিলেন। পর্তুগিজ পর্যটক পায়েজ, তাঁর মানবতা ও মহত্ত্বের প্রশংসা করেছেন।
কৃষ্ণদেব রায়ের মৃত্যুর পর বিজয়নগর সাম্রাজ্যের দুর্দিন ঘনিয়ে আসে। উত্তরাধিকারীদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সুযোগসন্ধানী ব্যক্তিরা বিজয়নগর রাজনীতিতে মাথাচাড়া দেয়। এই দুর্দিনে শেষ পর্যন্ত পার্শ্ববর্তী আহম্মদনগর, বিজাপুর, গোলকুণ্ডা এবং বিদরের সুলতানেরা সমবেতভাবে বিজয়নগরের উপর আক্রমণ চালায় এবং তালিকোটার যুদ্ধে (১৫৬৫ খ্রীঃ) বিজয়নগরকে পরাজিত করে।