বাংলাদেশে সংগঠিতভাবে খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের জন্য অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে উইলিয়াম কেরি (William Carey) বাংলাদেশে আসেন। জনসাধারণের বিষয়ে প্রথম থেকে উদ্যোগী উইলিয়াম কেরির মতো একজন প্রতিভাসম্পন্ন ভাষাবিজ্ঞানীর সহায়তা লাভ করায় ইংরেজ মিশনারীদের কর্মধারায় নতুন উদ্দীপনা সঞ্চারিত হয়। উইলিয়াম কেরি এদেশে এসে যথার্থভাবে কাজ আরম্ভ করবার মতো একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চেষ্টা করেন। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর পরিচালকদের সঙ্গে মিশনারীদের সম্পর্ক ভালো না থাকায় কোম্পানীর কর্তৃত্বাধীন কোন এলাকায় স্থায়িভাবে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা অসম্ভব হয়। ইতিমধ্যে উইলিয়াম কেরি একটি কাঠের তৈরী মুদ্রণযন্ত্র সংগ্রহ করেন, বাংলা ভাষায় বাইবেল অনুবাদের কাজও অনেকদূর অগ্রসর হয়, কিন্তু একটি স্থায়ী কেন্দ্র গড়ে তোলবার মতো স্থানের অভাবে অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে কোন কাজই এঁরা ভালোভাবে আরম্ভ করতে পারেন নি।
অবশেষে মিশনারীগণ ইংরেজ রাজত্বের বাইরে ডেনিশ শাসনাধীন শ্রীরামপুরকে কর্মকেন্দ্ররূপে নির্বাচন করেন। ১৮০০ খ্রীষ্টাব্দের ১০ই জানুয়ারি খিদিরপুর থেকে শ্রীরামপুর এসে উইলিয়াম কেরি অন্যান্য কর্মীদের সাথে মিলিত হন এবং ১২ই জানুয়ারি থেকে যথারীতি মিশনের কাজ শুরু হয়। গদ্যভাষা গড়ে তোলার দিক থেকে এঁদের রচনাবলীর মূল বিষয়ে মতান্তর আছে, কিন্তু মুদ্রণযন্ত্রের বৈপ্লবিক সহায়তায় ব্যাপক জনসমাজের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদানের মাধ্যম হিসেবে গদ্যের শক্তিবৃদ্ধির ঐতিহাসিক কৃতিত্ব শ্রীরামপুরের মিশনারীদের প্রাপ্য। মুদ্রিত বাংলা গ্রন্থ প্রকাশের যথার্থ ইতিহাসের সূচনা হয়েছে শ্রীরামপুরে মুদ্রণযন্ত্র স্থাপনের পর থেকে। শ্রীরামপুর থেকেই বাইবেলের অনুবাদ এবং অন্যান্য ধর্মপুস্তিকা ভিন্ন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের গ্রন্থাবলী এবং রামায়ণ-মহাভারতের মতো বৃহৎ গ্রন্থ মুদ্রিত হয়েছে। এই প্রেস থেকেই বাংলা ভাষায় প্রথম সাময়িকপত্র এবং সংবাদপত্রও ছাপা হয়। কোন সাহিত্যই মুদ্রণযন্ত্রের সহায়তা ভিন্ন আধুনিক যুগে উত্তীর্ণ হতে পারেনি; বাংলা সাহিত্যে আধুনিক যুগের সূচনা শ্রীরামপুরের মিশনারীদের সহায়তায়ই সম্ভব হয়েছিল একথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে মনে রাখা দরকার। এই ঐতিহাসিক ঘটনা সম্ভব হয়েছিল উইলিয়ম কেরির নেতৃত্বে, তাই বাঙালী-সংস্কৃতির ইতিহাসে তাঁর নাম চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।
মিশনের প্রেস থেকে বাংলা বই ‘Gospel of St Matthew’-এর অনুবাদ ‘মঙ্গল সমাচার মতিয়ের’ রচিত হয়। মূল গ্রীক থেকে এ বই অনুবাদ করা হয়েছিল। মূল অংশের শেষে ‘কালের অল্প বিবরণ এবং কতক ভবিষ্যৎ বাক্যে যীশুখ্রীষ্টের বিষয়’ নামে পাঁচ পৃষ্ঠার একটি পরিশিষ্ট যোগ করা হয়েছিল। এই অংশটুকু স্বাধীন রচনা, অনুবাদ নয়। এই পুস্তকটি ১৮০০ সালে ছাপা হয় মূল অংশের ভাষা বাংলা রীতি-বিরুদ্ধ, অনুবাদ বলেই এ ভাষা তেমন স্বাভাবিক নয়। পরিশিষ্ট অংশ স্বাধীনভাবে রচিত, তাই বাংলা গদ্যের ইতিহাসে এই অংশেরই মূল্য বেশী।
শ্রীরামপুরে আসার আগেই উইলিয়াম কেরি তাঁর বাংলা ভাষা-শিক্ষক রামরাম বসুর সহায়তায় বাইবেলের শেষ অনুবাদ করেছিলেন। ‘ধর্মপুস্তক’ নামে এক গ্রন্থ ১৮০১ খ্রীষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাসে প্রকাশিত হয়। সমগ্র ‘নিউ টেস্টামেন্ট’ এবং ‘ওল্ড টেস্টামেন্টে’র কিছু অংশের অনুবাদ এই গ্রন্থে নিবন্ধ ছিল। বাংলা গদ্যের ইতিহাসে স্মরণীয় এই গ্রন্থটি রচনার কৃতিত্ব কোন একজনের প্রাপ্য নয়। যদিও উইলিয়াম কেরি প্রধান উদ্যোগী ছিলেন এবং তিনিই ছিলেন শ্রীরামপুরের মিশনারীদের সকল কর্মের প্রেরণা- উৎস। তবুও গ্রন্থ রচনা বিষয়ে তিনি রামরাম বসু ও জন টমাসের সহায়তা যে গ্রহণ করতেন একথা নিশ্চিন্তভাবেই বলা যায়। শ্রীরামপুর থেকে এই গ্রন্থের শেষ সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৮৩২-৩৩ খ্রীষ্টাব্দে। প্রতি সংস্করণেই ভাষার সংস্কার সাধন করা হয়েছে, কিন্তু রচনাশৈলী বিশেষ উন্নত হয় নি। তবুও এই প্রচেষ্টায় বিশেষভাবে উইলিয়াম কেরির অকৃত্রিম নিষ্ঠার পরিচয় পাওয়া যায়। উইলিয়াম কেরিই ছিলেন শ্রীরামপুর মিশনের প্রধান নায়ক, কিছুদিন পরে তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে অধ্যক্ষপদ গ্রহণ করে চলে যাওয়ায় গ্রন্থ রচনার দিকে মিশনের ভূমিকার গুরুত্ব কমে যায়।
শ্রীরামপুর মিশনের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাংলায় সাময়িকপত্র প্রকাশ। বাংলা ভাষায় প্রথম মাসিক পত্র ‘দিগদর্শন’ এখান থেকেই ১৮১৮ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয়। ‘দিগদর্শন’ প্রকাশের এক মাসের মধ্যে মিশন ‘সমাচার দর্পণ’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। উভয় পত্রিকারই সম্পাদক ছিলেন জন ক্লার্ক মার্শম্যান। সাময়িক পত্রিকা অবলম্বন করেই উত্তরকালে বাংলা গদ্যভাষার দ্রুত বিকাশ সম্ভব হয়েছে, শ্রীরামপুর মিশন এইদিক থেকেও অগ্রণীর ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।