নেপোলিয়নের পতনের পর প্যারিস সন্ধির দ্বারা বংশানুক্রমিক শাসননীতি অনুসারে বুরবোঁ রাজতন্ত্রকে ফ্রান্সের সিংহাসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হয়। বুরবোঁ রাজা ষোড়শ লুইয়ের ভ্রাতা অষ্টাদশ লুই (Louis XVIII) ফরাসী সিংহাসনে বসেন। এরপর ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে চরম প্রতিক্রিয়াশীল দশম চার্লস ফ্রান্সের সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং উগ্র রাজতন্ত্র ও স্বেচ্ছাতন্ত্র প্রণয়নে যত্নবান হন। চার্লসের জনবিরোধী কার্যকলাপ এবং স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসাবে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে প্যারিসের জনতা যে গণ অভ্যুত্থানের সূচনা করে ফ্রান্সের ইতিহাসে সেই গণ অভ্যুত্থান জুলাই বিপ্লব (July Revolution) নামে পরিচিত।
জুলাই বিপ্লবের কারণ (Causes of July Revolution)
মধ্যপন্থা নীতির ব্যর্থতা: ফ্রান্সের সিংহাসনে বসার পর অষ্টাদশ লুই আপোষমুখী নীতি নিয়ে দেশ শাসন আরম্ভ করেন। অষ্টাদশ লুই বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লবের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের নীতি নেন। ফ্রান্সের জনগণকে আশ্বস্ত করার জন্যে অষ্টাদশ লুই ১৮১৪ খ্রীঃ একটি চার্টার বা সনদ দান করেন। এই সনদে কয়েকটি ত্রুটি ছিল যার ফলে ঘোর বিরোধ দেখা দেয়। প্রথমতঃ, সনদে স্বর্গীয় অধিকার নীতিকে নাকচ করা হয়। রাজার হাতে শাসন পরিচালনার ক্ষমতা, আইন অনুমোদনের ক্ষমতা, মন্ত্রী নিয়োগের ক্ষমতা এবং সনদের ১৪ নং ধারা অনুসারে বিশেষ ক্ষমতা বলে আইনসভা ভঙ্গ করার ক্ষমতা থাকায়, রাজাই প্রধান ক্ষমতার আধার হন। দ্বিতীয়তঃ, মন্ত্রীসভা তাদের কাজের জন্যে আইনসভার নিকট দায়িত্ববদ্ধ ছিল না। শাসন বিভাগের ওপর আইনসভার নিয়ন্ত্রণ না থাকায় শাসন বিভাগ দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করার সুযোগ পায়। তৃতীয়তঃ, ভোটাধিকার কেবলমাত্র ৩০০ ফ্রাঁ কর প্রদানকারীদের দেওয়ার ফলে ৩০ মিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে মাত্র ৯০ হাজার লোক ভোটদানের অধিকার পায়। বাকি লোকেরা ভোটদানের অধিকারে বঞ্চিত হয়। মোট কথা, উচ্চ বুর্জোয়া শ্রেণীই ভোটদানের অধিকার পায়।
দশম চার্লসের প্রতিক্রিয়াশীলতা: অষ্টাদশ লুইয়ের পর তাঁর ভ্রাতা দশম চার্লস ফ্রান্সের সিংহাসনে বসেন। তিনি সিংহাসনে বসার আগে উগ্র রাজপন্থীদলের নেতা ছিলেন। তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল অষ্টাদশ লুইয়ের মধ্যপন্থা নীতি নাকচ করে অভিজাত ও যাজকদের সাহায্যে পুরাতনতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনা। তিনি ভিলীলের সাহায্যে প্যারিসের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ গীর্জার হাতে ছেড়ে দেন। স্যাক্রিলেজ আইন দ্বারা গীর্জায় চুরি প্রভৃতি অপরাধের জন্যে কঠোর দণ্ড দানের ব্যবস্থা করা হয়। তিনি দেশত্যাগী অভিজাতদের সন্তুষ্ট করার জন্যে ক্ষতিপূরণ আইন পাশ করেন। এই আইনের দ্বারা যে সকল অভিজাতদের জমি বিপ্লবের সময় বাজেয়াপ্ত হয়েছিল, তাদের ১ বিলিয়ন ফ্রাঁ ক্ষতিপূরণ দানের ব্যবস্থা করা হয়। ক্ষতিপূরণের অর্থ যোগাড়ের জন্যে সরকার জাতীয় ঋণের সুদের হার ৫% থেকে কমিয়ে ৩% করেন। এর ফলে হুটে বুর্জোয়া শ্রেণী বা ব্যাঙ্ক মালিকদের আয় কমে যায়। এই শ্রেণী সরকারের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গে বিরক্ত হয়।
পলিগন্যাক মন্ত্রীসভার প্রতিক্রিয়াশীল নীতি: রাজা দশম চার্লস উগ্র রাজপন্থী পলিগন্যাক-কে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করেন। পলিগন্যাক ছিলেন প্রতিক্রিয়াপন্থী। তিনি বলেন যে, আমার লক্ষ্য হল সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে ধর্মযাজকদের লুপ্ত অধিকার দান এবং অভিজাতদের বিশেষ অধিকারের পুনঃস্থাপন। পলিগন্যাকের প্রতিক্রিয়াশীল নীতি উদারপন্থী ও প্রজাতন্ত্রী দলগুলির মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ইতিমধ্যে ১৮৩০ খ্রীঃ নির্বাচনে আইনসভার উদারপন্থীরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। তারা একটি প্রস্তাব দ্বারা পলিগন্যাক মন্ত্রীসভাকে বরখাস্ত করার প্রতিক্রিয়াশীল নীতি জন্যে রাজার নিকট দাবী জানায়।
চার্লস কর্তৃক জুলাই অর্ডিন্যান্স জারি: আইনসভায় উদারপন্থীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং প্যারিসে প্রজাতন্ত্রীদের বিরোধিতার সম্মুখীন হয়ে দশম চার্লস পলিগন্যাকের পরামর্শে আইনসভা ভেঙে দেন। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই সনদের ১৪নং ধারা অনুযায়ী দশম চার্লস বিশেষ অধিকার প্রয়োগ করে “জুলাই অর্ডিন্যান্স” (July Ordinances) জারী করেন। জুলাই অর্ডিন্যান্স অনুসারে—(১) সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করা হয়; (2) আইনসভা ভঙ্গ করা হয়; (৩) নির্বাচন আইন পরিবর্তন করে বুর্জোয়া শ্রেণীকে ভোটাধিকারে বঞ্চিত করা হয়। (৪) নতুন নির্বাচন আইন অনুসারে নির্বাচনের দিন ঘোষণা করা হয়।
দশম চার্লসের সিংহাসন ত্যাগ: জুলাই অর্ডিন্যান্সের বিরুদ্ধে উদারপন্থী ও প্রজাতন্ত্রী দলগুলি সক্রিয় প্রতিবাদ জানায়। তারা প্যারিসের রাস্তায় অবরোধ গড়ে রাজকীয় বাহিনীর সঙ্গে সংগ্রাম আরম্ভ করে। প্যারিসের মধ্যবিত্তশ্রেণী বিদ্রোহীদের পক্ষে যোগ দেয়। প্যারিসের জনতার সংহার মূর্তি দেখে দশম চার্লস জুলাই অর্ডিন্যান্স প্রত্যাহার করলেও, বিদ্রোহীরা তাঁর পদত্যাগ দাবী করে। শেষ পর্যন্ত ৩০শে জুলাই দশম চার্লস তাঁর পৌত্র ডিউক অফ বোর্দোর অনুকূলে পদত্যাগ করেন। কিন্তু বিপ্লবীরা বুরবোঁ বংশের দাবী উপেক্ষা করে অর্লিয়েন্স বংশীয় লুই ফিলিপকে ফ্রান্সের রাজা মনোনীত করে। আইনসভা লুই ফিলিপকে সাংবিধানিক রাজা হিসেবে ঘোষণা করে। দশম চার্লস পালিয়ে ইংলন্ডে আশ্রয় নেন। জুলাই বিপ্লব সম্পন্ন হয়।