বহু শিক্ষাবিদ শিশুশিক্ষায় গৃহ-পরিবারের অবদানের কথা স্বীকার করেছেন। তাঁরা বলেছেন গৃহই শিশুর নির্ভরযোগ্য বিদ্যালয়। এখান থেকেই শুরু হয় শিশুর জীবনের সকল প্রকার চাহিদার পরিতৃপ্তি। তাঁদের মতে গৃহের উপযুক্ত কোমল স্নেহমাখা পরিবেশের প্রভাব শিশুদের মনে অকৃত্রিম নিরাপত্তাবোধ জাগিয়ে তুলে তাদের জীবনকে প্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে চলে। শিশুর সকল প্রকার সহজাত সম্ভাবনা, প্রবৃত্তি-প্রক্ষোভ, প্রবণতা ও সামর্থ্য মাতাপিতা ও গৃহ-পরিজনকে কেন্দ্র করেই নানারকম সৃষ্টিধর্মী কাজের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায়।
গৃহের পক্ষে শিক্ষার দায়িত্ব নিতে না পারার কারণ
সামাজিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এই গৃহ-পরিবার মূল্যবান দায়িত্ব পরিপূর্ণভাবে বহন করতে নিয়তই অসামর্থ্য হয়ে উঠছে। বর্তমান আধুনিক গৃহ বা পরিবারের চিত্র যে কতখানি করুণ তা না বললেও অনুমেয়।
ক্রমাগত বর্ধিত জনসংখ্যাই এর একমাত্র প্রধান কারণ। এই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্যই প্রতিটি পরিবারে দেখা দিয়েছে খাদ্য সমস্যা, উপযুক্তভাবে বসবাসের সমস্যা, আলো-জল-বাতাসের সমস্যা, পারস্পরিক সুসম্পর্ক গড়ে তোলার সমস্যা এবং অর্থনৈতিক সমস্যা। জীবন সংগ্রামে পর্যুদস্ত পরিবার আজ শিশুশিক্ষায় বিশেষ তালিকামাফিক কর্তব্য পালন করতে পারছে না।
শিক্ষাবিদ রাসেলের মতে শিশুশিক্ষার পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত পরিমাণ আলো-জল বাতাস। কিন্তু আমাদের মতন দেশের বেশিরভাগ পরিবারের মধ্যে সুস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি করা অকল্পনীয়। পরিবারের এইরকম অবস্থায় গৃহ শিশুশিক্ষার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে না। এরজন্য অর্থনৈতিক, পারিবেশিক, সামাজিক ও মানসিক কারণ সমভাবে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে থাকে।
প্রসঙ্গত বলতে হয় যে এই অনুন্নত পরিবেশ ছাড়াও উন্নত পরিবেশে অন্যরকম করুণ চিত্র অন্যরূপে লক্ষ্য করা যায়। উদাহরণস্বরূপ আজও আমাদের দেশের জনসাধারণকে বোঝাতে হয়। যে ‘ছোট পরিবার সুখী পরিবার’। আজও এই সত্যটুকু জনসাধারণ নিজের থেকে বুঝতে পারে না উপযুক্ত প্রচারকার্য, উপযুক্ত শিক্ষা ও আর্থিক সাহায্য ব্যতিরেকে। স্বাভাবিক এই অনুভূতির অভাবেই পরিবারে জনসংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাচ্ছে।
ফলত পরিবারে দেখা দিচ্ছে স্বাভাবিক শিক্ষা-পরিবেশের অভাব। অর্থনৈতিক দুরবস্থার প্রেক্ষাপটে কোনপ্রকার দিনযাপনের এবং প্রাণ ধারণে গ্লানি বহন করে প্রতিটি পরিবার আরোও পর্যুদস্ত হয়ে পড়ছে। বর্তমানে কলহ, বিবাদ ও হানাহানি প্রায় প্রতিটি পরিবারের পরিবেশকে করে তুলেছে শিক্ষার পক্ষে অনুপযোগী।
বলা বাহুল্য, শিশুশিক্ষার দায়িত্ব নেওয়ার মত মানসিকতা কোন গৃহেই আর অনুভব করা যাচ্ছে না। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায় যে পৃথিবীর তৃতীয় বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই প্রতিটি গৃহ আজ তার পরিবারের সদস্যদের জীবন বিকাশের সাথে সংযুক্ত বিভিন্ন দৈহিক, অর্থনেতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক বিকাশের সমস্যা নিয়ে এত বেশি ব্যস্ত থাকে যে তার পক্ষে পৃথক পথে পরিবারের পড়ুয়া সদস্যদের বয়সভিত্তিক স্তরভেদের শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া অসম্ভব হয়ে ওঠে।
তাছাড়া আগে যৌথ পরিবারের সদস্যদের অনেকেই নিজের পুত্র-কন্যাদের শিক্ষার জন্য পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনদের ওপর অনেকটা নির্ভর করতে পারতেন। কিন্তু এখন যৌথ পরিবারের অবলুপ্তির সাথে সাথে একক পরিবারের আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে বাবা ও মা উভয়কেই নিজস্ব পরিবারের অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সমস্যা নিয়ে এত বেশি ব্যস্ত থাকতে হয় যে তাদের পক্ষে উপযুক্ত বিদ্যালয়ের সাহায্য ছাড়া নিজেদের ছেলেমেয়েদের বিদ্যাশিক্ষার ব্যাপারে নিযুক্ত থাকা অসম্ভব হয়ে ওঠে।
পরিশেষে অবশ্যই বলতে হয় যে বর্তমান গৃহের পক্ষে পরিবারের পড়ুয়া সদস্যদের দায়িত্ব নেওয়া কাম্য ও বাঞ্ছিত হলেও তা সত্যই অসম্ভব। পরিবারের নিজস্ব কাজ সামলে সকল পরিবারের পক্ষে শিশুদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য উপযুক্ত সময় ও সামর্থ্য পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। পরিবারকে তাই ন্যস্ত করতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে বিদ্যালয়ের উপর।