সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অনেকে প্রশ্ন তোলেন যে, সুইজারল্যান্ডের শাসনব্যবস্থাকে কি রাষ্ট্রপতি পরিচালিত শাসনব্যবস্থা (Presidential types) অথবা সংসদীয় ব্যবস্থার (Parliamentary type) সঙ্গে তুলনা করা চলে। আবার অনেকে মনে করেন যে, সুইজারল্যান্ডের শাসনব্যবস্থার সঙ্গে রাষ্ট্রপতি পরিচালিত শাসনব্যবস্থা বা সংসদীয় শাসনব্যবস্থা—কোনটির সঙ্গে সম্পূর্ণ মিল নেই।
সুইজারল্যান্ডের যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনবিভাগকে (Federal Council) কোন অবস্থাতে সংসদীয় ব্যবস্থার ক্যাবিনেটের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থাকে পার্লামেন্টারী বা ক্যাবিনেট শাসনব্যবস্থার শ্রেষ্ঠ নজির হিসাবে উল্লেখ করা হয়। মন্ত্রিগণ, পার্লামেন্টের সদস্য এবং পার্লামেন্টের সদস্য হিসাবেই তারা ইংল্যান্ডের রাণীর দ্বারা নিযুক্ত হন। মন্ত্রিরা পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ কমন্স সভার (House of Commons) কাছে যৌথভাবে দায়ী থাকেন। পার্লামেন্টের আস্থা হারালে মন্ত্রিদের অর্থাৎ সমগ্র ক্যাবিনেটকে পদত্যাগ করতে হয়।
প্রথমত, সুইজারল্যান্ডের শাসনব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন বিভাগ অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিষদের (federal Council) সদস্যগণ আইন সভার সদস্য হওয়ার পর আইনসভা কর্তৃক যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিষদের সদস্য অর্থাৎ মন্ত্রী হিসাবে নিযুক্ত হন। কিন্তু মন্ত্রী হিসাবে নিযুক্ত হওয়ার পর আর আইন সভার সদস্য থাকেন না। এটা সুইজারল্যান্ডের শাসনব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য। সুইস শাসনব্যবস্থা কিছু পরিমাণে সংসদীয়, আবার কিছুটা অ-সংসদীয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিষদ আইনসভার কাছে নতি স্বীকার করে। কিন্তু আইনসভার অনাস্থায় মন্ত্রি-পরিষদের সদস্যদের পদত্যাগ করতে হয় না। ইংল্যান্ডের ক্যাবিনেট শাসন নীতি নির্ধারণ করে, সুইজারল্যাণ্ডে নীতি নির্ধারণ করে আইনসভা, শাসন পরিষদ সেই নীতি কার্যকর করে।
দ্বিতীয়ত, ভারত, ইংল্যান্ড প্রভৃতি অন্যান্য সংসদীয় ব্যবস্থায় আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল মন্ত্রিসভা গঠন করে। কিন্তু সুইজারল্যান্ডে দলীয় ভিত্তিতে সরকার গঠিত হয় না। আইনসভায় বিভিন্ন দলের সদস্যদের নিয়ে শাসন পরিষদ গঠিত হয়।
তৃতীয়ত, সুইস যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিষদের কার্যকাল যদিও ৪ বছর কিন্তু পুনর্নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোন বাধা নেই। সদস্য তাদের এই স্থায়িত্ব পার্লামেন্টীয় বা ক্যাবিনেট শাসন ব্যবস্থায় লক্ষ্য করা যায় না। সংবিধান বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাইসীর (Dicey) মতে, সুইস যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিষদ যৌথ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পরিচালকমণ্ডীর (Board of Directors) মত। আস্থাভাজন শাসন পরিচালক দ্বারা আইনসভার ইচ্ছাকে কার্যকর করার জন্যে এদের নিয়োগ করা হয়। সুতরাং কার্যকালের মেয়াদ বাড়ানোর জন্যে এদের পুনরায় নির্বাচিত করা হয়।
চতুর্থত, সুইস যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন পরিষদ সমমর্যাদাসম্পন্ন বহুজন বিশিষ্ট পরিষদ (Pluaral Executive) ৭ জন সদস্যের মধ্যে থেকে আইনসভা ১জনকে সভাপতি নির্বাচিত করে। তিনি শাসন পরিষদের অন্যান্য সদস্য অপেক্ষা অধিক ক্ষমতা ভোগ করেন না। সুতরাং ক্যাবিনেট শাসন ব্যবস্থার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সুইস শাসন পরিষদের সভাপতির তুলনা করা চলে। ক্যাবিনেট ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী হলেন শাসন পরিচালনার মূল ভিত্তি।
পঞ্চমত, ক্যাবিনেট বা পার্লামেন্টীয় ব্যবস্থায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নীতি হ’ল মন্ত্রিদের যৌথ দায়িত্বশীলতা (Collective responsibility)। ক্যাবিনেটের সিদ্ধান্ত, সকল মন্ত্রিদের মান্য করতে হয়, তারা যৌথ ভাবেই পার্লামেন্টের কাছে দায়ী থাকেন। অবশ্য মন্ত্রিদের ব্যক্তিগতভাবে দায়িত্বও থাকে। সুইজারল্যান্ডে শাসন পরিষদের সদস্যগণ ব্যক্তিগত দায়িত্বেই কাজ করেন। অনেকে বলেন ‘যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিষদ বলে এখানে কিছু নেই, আছে শুধু যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিষদের সদস্যগণ’।
ষষ্ঠত, ক্যাবিনেট ব্যবস্থায় ক্যাবিনেটই নীতি নির্ধারণ করে। সুইজারল্যান্ডে নীতি নির্ধারণ করে আইনসভা। শাসন পরিষদের সদস্যদের পদত্যাগের প্রশ্ন এখানে ওঠে না।
সপ্তমত, ইংল্যান্ড ও ভারতে রাষ্ট্রপ্রধান আইন সভার অধিবেশনে ক্যাবিনেট রচিত অভিভাষণ পাঠ করেন। এই অভিভাষণে ক্যাবিনেটের নীতিগুলি উল্লেখ করা হয়। সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রপতি যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন পরিষদের নীতি ঘোষণা করে কোন বক্তৃতা দেন না।
তাছাড়া পার্লামেন্টীয় ব্যবস্থায় শাসন বিভাগ রাষ্ট্রপ্রধানকে আইনসভা ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচনের পরামর্শ দিতে পারেন। ইংল্যান্ডে প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে নির্বাচনের জন্য রাণীকে পরামর্শ দিতে পারেন, কিন্তু সুইজারল্যান্ডে এই ধরনের কোন ব্যবস্থা নেই।
অন্যদিকে সুইস শাসন ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রপতি পরিচালিত শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পূর্ণ তুলনা করা যায় না।
প্রথমত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তত্ত্বের দিক থেকে এবং বাস্তবে রাষ্ট্রপতিই শাসক প্রধান। সকল শাসন ব্যবস্থার শীর্ষে তাঁর অবস্থান।
কিন্তু সুইস যুক্তরাষ্ট্রে শাসন ব্যবস্থার শীর্ষে আছে যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিষদ। পরিষদের সকল সদস্য সমান ক্ষমতাসম্পন্ন। আইনসভা পরিষদ সদস্যদের মধ্যে থেকে ১জনকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে। তিনি দেশের আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রপতি, প্রকৃত রাষ্ট্রপতি বা কর্ণধার নন।
দ্বিতীয়ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি অনুসৃত হয়। ক্যাবিনেট সদস্যদের মার্কিন রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করেন। সুইজারল্যান্ডে শাসন পরিষদের সদস্যদের প্রথমে আইন সভার সদস্য হতে হয়। কিন্তু মন্ত্রী হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁদের আইনসভার সদস্যপদ ত্যাগ করতে হয়। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি সুইস শাসন ব্যবস্থায় পুরোপুরি গৃহীত হয় নি। মার্কিন রাষ্ট্রপতি ক্যাবিনেট সদস্যদের পদচ্যুত করতে পারেন, কিন্তু সুইজারল্যান্ডে আইনসভা শাসন পরিষদকে পদচ্যুত করতে পারে না।
তৃতীয়ত, ব্রিটেনে ক্যাবিনেট এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি দলীয় নির্দেশে কাজ করেন। দলীয় রাজনীতির টানাপোড়েন তাঁরা উপেক্ষা করতে পারেন না। কিন্তু সুইস শাসন ব্যবস্থায় শাসন পরিষদ সদস্যগণ দলীয় নির্দেশে কাজ করেন না।
চতুর্থত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির জন্যে রাষ্ট্রপতি আইন সভার কাজে অংশগ্রহণ করেন। না। কিন্তু তাঁর আইনসংক্রান্ত কিছু ক্ষমতা আছে। আইন পাসের বিষয়ে তাঁর ভিটো ক্ষমতা বা বিল নাকচ করার ক্ষমতা আছে। সুইস শাসন পরিষদের সদস্যগণ আইন সভার বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন। আইনসভার কাজ পরিচালনা করেন। কিন্তু কোন বিল নাকচ করার ক্ষমতা ভোগ করেন না। সুইস শাসন পরিষদ আইনসভার এজেন্ট মাত্র।
পঞ্চমত, সুইজারল্যান্ডে শাসন পরিষদের কার্যকাল ৪ বছর হলেও সদস্যগণ পুনরায় নির্বাচিত হতে পারেন। যার ফলে শাসন পরিষদ স্থায়ী পরিষদের রূপ লাভ করে। সুইস রাষ্ট্রপতি ১ বছরের জন্যে নির্বাচিত হন। মার্কিন রাষ্ট্রপতি ২ বারের বেশী (৪ বছর ৪ বছর = মোট ৮ বছর) নির্বাচিত হতে পারেন না। সুইজারল্যান্ডে মন্ত্রীরা বারংবার নির্বাচিত হতে পারেন।
• মন্তব্য: আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সুইজারল্যান্ডের শাসনব্যবস্থায় ক্যাবিনেট বা পার্লামেন্টীয় ব্যবস্থা অথবা রাষ্ট্রপতি পরিচালিত শাসন ব্যবস্থার কোনটাই পুরোপুরি গৃহীত হয় নি। এখানে কিছু পার্লামেন্টীয় এবং কিছু রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য বর্তমান। আসলে সুইজারল্যান্ডের শাসন ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য বিশিষ্ট (a class by itself) শাসন ব্যবস্থা বলা যায়।