ভারতীয় অর্থনীতির এক প্রাচীন ঐতিহ্য হল রাষ্ট্রীয় কারখানা। সুলতানী আমলে কারখানার অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। মুঘল যুগে রাজকীয় কারখানার ধারা অক্ষুণ্ণ ছিল। বৃহদায়তন উৎপাদন ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে বাজার থেকে অজস্র প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী সংগ্রহ অসম্ভব ছিল। সেজন্য রাষ্ট্র সর্ববৃহৎ উৎপাদকে পরিণত হয়েছিল।
কেন্দ্রীয় রাজধানী ছাড়াও প্রাদেশিক রাজধানীতে রাজকীয় কারখানা (Imperial Karkhanas) স্থাপিত হয়েছিল। আকবরের আমলে অগ্রা, ফতেপুর সিক্রি, লাহোর, আমেদাবাদ ও অন্য জায়গায় সরকারি রাজকীয় কারখানা স্থাপিত হয়েছিল। শাহজাহান ও ঔরঙ্গজেবের আমলে দিল্লি, বুরহানপুর, ঔরঙ্গাবাদ ও কাশ্মীরে রাজকীয় কারখানা স্থাপিত হয়েছিল। আবুল ফজল অন্তত একশোর বেশি জায়গার নাম করেছেন যেখানে রাজকীয় কারখানাকে কেন্দ্র করে শহর গড়ে উঠেছিল। আকবর স্বয়ং উৎপাদন কর্মে অংশ গ্রহণ করতেন বলে প্রত্যক্ষদর্শী মনসারেট জানিয়েছেন। তাঁত বস্ত্র বয়ন, রং, ছাপা, বৈচিত্র্যময় সিল্ক ও শাল প্রস্তুত, নকশা ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে আকবরের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ উৎপাদন ব্যবস্থায় অনুপ্রেরণা জোগাত।
সম্রাটের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে রাজকীয় কারখানায় বন্দুক নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি ঘটানো সম্ভব হয়েছিল। জাহাঙ্গীরের শাসনকালে রাজকীয় কারখানা থেকে অতি উন্নত মিশ্র ধাতুর অস্ত্র তৈরি হয়েছিল। শাহজাহান রাজকীয় কারখানায় বহু মূল্যবান শৌখিন জিনিষ তৈরি করতে উৎসাহ দিতেন। তিনি প্রাসাদের শিল্পী দিয়ে একটি আড়াই লক্ষ টাকা দামের রত্নখচিত স্ফটিকের মোমদান তৈরি করে মক্কার পবিত্র শরীফে প্রদান করেন।
সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগে বার্নিয়ের প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে দিল্লির প্রাসাদ কারখানার নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে, দিল্লির প্রাসাদ কারখানায় তৈরি কোন কোন পোষাক হয়তো কয়েক ঘন্টার জন্য ব্যবহৃত হত যার মূল্য ১০-১২ কোটি টাকা। শহরগুলিতে রাজা ও রাজ প্রাসাদ ছিল সবচেয়ে বড় উৎপাদক। তবে এদের কারখানায় উৎপন্ন জিনিস বাজারে বিক্রি হত না। এগুলি দরবারে ও অন্তঃপুরে ব্যবহৃত হত এবং দরবারের বিভিন্ন পদস্থ কর্মচারী, বিদেশি রাজদূত প্রভৃতিকে সম্রাট উপহার দিতেন।
সম্রাটের কারখানায় পোশাক, অস্ত্রশস্ত্র, সামরিক সরঞ্জাম, শিবিরের তাঁবু, ঘোড়া ও হাতীর সরঞ্জাম ইত্যাদি তৈরি হত। সম্রাটের কারখানায় বিচিত্র ধরনের কারিগররা উৎপাদনের কাজে নিযুক্ত ছিল। সম্রাটের নির্দেশে সুবাদার, পদস্থ রাজকর্মচারী ও জায়গীরদাররা সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে দক্ষ কারিগর সংগ্রহ করে রাজকীয় কারখানায় কাজ করার জন্য পাঠিয়ে দিত। এমন কি তুরস্ক, পারস্য, চিন ও ইউরোপ থেকে দক্ষ কারিগরদের ভারতে এসে কাজ করার জন্য জাহাঙ্গীর আমন্ত্রণ করে এসেছিলেন। স্বর্ণকার, সুচিশিল্পী, চিত্রকর, রঙের মিস্ত্রি, লাক্ষা শিল্পী, মিস্ত্রি, দরজী, চামার, বর্ম প্রস্তুতকারকদের উল্লেখ পাওয়া যায়।
মুঘল যুগে প্রাদেশিক শাসনকর্তা, সুলতান অথবা অন্যান্য অভিজাত শ্রেণি কারখানা স্থাপন করত। আগ্রা, লাহোর, ফতেপুর সিক্রি, আমেদাবাদ, বরহানপুর, কাশ্মীরের শাসনকর্তারা স্থানীয় উৎপাদকদের পৃষ্ঠপোষকতা করত। এই সব প্রাদেশিক কারখানায় শৌখিন মূল্যবান প্রয়োজনীয় সামগ্রী তৈরি করা হত যেগুলি সম্রাটকে উপহার হিসাবে দেওয়া হত। গোলকুণ্ডার সুলতানের নিজস্ব কারখানা ছিল। বারাণসীর মহারাজা তাঁর রামনগর প্রাসাদে নিজস্ব কারখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মোগল যুগে স্বাধীন বড় বড় কারুশিল্পীদের নিজস্ব কারখানা ছিল।