পুঁজিবাদীরা সংগঠিতভাবে শিল্পে একচেটিয়া আধিপত্য স্থাপন ও একচেটিয়া মুনাফা লাভের যে নীতি নেয়, তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ইউরোপের শ্রমিকরা (Labour) তাদের দাবী আদায় ও অধিকার রক্ষার জন্যে ট্রেড ইউনিয়ন (Trade Union) গঠনের উদ্যোগ নেয়। ইউটোপীয় সমাজতন্ত্রবাদীরা দীর্ঘকাল ধরে শ্রমিক সমবায় ও শ্রমিক গঠনের তত্ত্ব প্রচার করে শ্রমিকদের সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোঝান। তৎকালীন সরকার ছিল পুঁজিবাদীদের সমর্থক। সুতরাং সরকারের বিরোধিতা অগ্রাহ্য করে বে-আইনীভাবে শ্রমিক সংগঠন তৈরি করা সহজ কাজ ছিল না। ফরাসী সমাজতন্ত্রবাদী লুই ব্লাঙ্ক (Louis Blanc) বলেন যে, শ্রমিকরা পার্লামেন্টের সদস্য হতে পারলে তারা আইনকে শ্রমিকের স্বার্থের অনুকুলে আনতে পারবে। তার ফলে শুধু শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষাই হবে না, শ্রমিক ইউনিয়ন বা শ্রমিক সংগঠনের বিরোধীতার পথ থেকে সরকার সরে আসতে বাধ্য হবে। গণভোটের প্রবর্তন হলে তার সুযোগ নিয়ে শ্রমিক প্রতিনিধিরা পার্লামেন্টে নির্বাচিত হতে পারবে।
সরকারের রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গীকে বদলান সহজ কাজ ছিল না। কারণ পুঁজিবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর ফলে পার্লামেন্ট তথা সরকারগুলি শ্রমিক আন্দোলনের ওপর হাজার রকমের নিয়ন্ত্রণমূলক শর্ত চাপাত। সরকারের মনোভাব ছিল যে, শ্রমিকরা মালিকের সঙ্গে কারখানায় কাজ করতে চুক্তিবদ্ধ। সেক্ষেত্রে ধর্মঘট করা শুধু বেআইনী কাজ নয়, চুক্তিভঙ্গ করার সামিল। এজন্য ট্রেড ইউনিয়ন ও ধর্মঘটের ওপর বাধা-নিষেধ চাপান হয়। ১৯০০ খ্রীঃ ব্রিটেনের টাকভেল রেল কোম্পানীতে বর্ধিত বেতনের দাবীতে শ্রমিকরা ধর্মঘট করায় ট্রেড-ইউনিয়নগুলির ওপর চুক্তি ভঙ্গের অজুহাতে আদালত ২৩ হাজার পাউন্ড জরিমানা ধার্য করে। এর থেকেই বোঝা যায় যে, শ্রমিকদের দাবী পূরণের জন্যে বৈধ আন্দোলন করা সহজ কাজ ছিল না।
ইংল্যান্ডে সর্বসাধারণের ভোটাধিকারের দাবীতে চার্টিস্ট আন্দোলন (Chartist Movement) শুরু হলে শ্রমিকরা যোগ দেয়। ১৮৩২ খ্রীঃ ইংলন্ডে ভোটাধিকার আইন দ্বারা শহরাঞ্চলে ভোটাধিকার সম্প্রসারণ করা হলেও, সম্পত্তির ভিত্তিতে ভোটাধিকার চালু থাকায় শ্রমিকরা তাতে উপকৃত হয়নি। ঊনবিংশ শতকের ৬০-এর দশকে ভোটাধিকারের দাবীতে ইংল্যান্ডে গণ আন্দোলন দেখা দেয়। এই সময় ইংল্যান্ডের কোয়েকার সম্প্রদায় শ্রমিকের ভোটাধিকার লাভের জন্যে প্রচার চালায়। জন ব্রাইট ন্যাশন্যাল রিফর্ম লীগ গঠন করে তাতে শ্রমিক ও ট্রেড ইউনিয়নগুলিকে সামিল করেন। ১৮৬৬ খ্রী: হাইড পার্কে ভোটাধিকারের দাবীতে এ জনসভা ডাকা হলে সরকার তা নিষিদ্ধ করায়, রুদ্ধ শ্রমিকরা হাইড পার্কের রেলিং টেনে ভেঙে ফেলে। পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের খণ্ডযুদ্ধ বাধে। এই ঘটনা গোটা ইউরোপে দারুণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ইংল্যান্ডে, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশের শাসক শ্রেণী উপলব্ধি করেন যে, শ্রমিকদের দাবী পূরণ না করলে, শিল্প-সমৃদ্ধ ইউরোপের সমাজে নতুন ধ্বস দেখা দিবে।
ইংল্যান্ডে সচেতনতা অনুভূত হয়। এর ফলে ১৮৬৭ খ্রীঃ ভোটাধিকার আইন পাশ হলে শ্রমিক সহ বেশীর ভাগ লোক ভোটাধিকার লাভ করে। শ্রমিকরা ভোটাধিকার পেলে ১৮৭০ খ্রী: ব্ল্যাডস্টোন তার বিখ্যাত শিক্ষা সংস্কার আইন দ্বারা শ্রমিকদের অন্ততঃ প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ দানের চেষ্টা করেন। তিনি ১৮৭১ খ্রীঃ এক আইন দ্বারা ইংলণ্ডের শ্রমিকদের বৈধ ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অধিকারকে স্বীকৃতি দেন। শেষ পর্যন্ত ইংলন্ডে শ্রমিক দল গঠিত হয়।
ইংলন্ডে ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রবাদীরা প্রচার করেন যে, ডারউইন জীবজগতে বিবর্তন তত্ত্বের মাধ্যমে যেরূপ পরিবেশ ও পরিস্থিতির পরিবর্তনের সঙ্গে জীবজগতে বিবর্তন তত্ত্ব প্রমাণ করেছেন, মনুষ্য সমাজে সেরূপ বিবর্তনের পথেই সমাজতন্ত্র আসবে। শিল্প যুগ আরম্ভ হওয়ার ফলে শ্রমিকের দাবীকে অগ্রাহ্য করে সমাজ কখনও চলতে পারবে না। ফেবিয়ানবাদ ইংলন্ডের শ্রমিক আন্দোলনকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। এই সময় জেমস কায়ার হার্ডি ইংলন্ডে শ্রমিক দল স্থাপন করেন। বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়নগুলি শ্রমিক দলের প্রতি আনুগত্য জানায়। শ্রমিক দল পার্লামেন্টে শ্রমিক সদস্যের সংখ্যা দ্রুত বাড়াতে সক্ষম হয়। ১৯১০ খ্রী: হাউস অব কমন্সে ৪০ জন সদস্য ছিল শ্রমিক দলের। শ্রমিক সদস্যদের দাবীতে পার্লামেন্ট ইংলন্ডে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনকে বৈধতা দানের আইন পাশ করতে বাধ্য হয়।
ফ্রান্সের সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন ফরাসী শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার দেন। কিন্তু ১৮৭০-৭১ খ্রীঃ প্যারিস কমিউনের বিদ্রোহের ফলে তৃতীয় প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি থিয়ার্স শ্রমিক ও ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের (Labour and Trade Union Movements) ওপর নিষেধাজ্ঞা চাপান। ১৮৮০-র দশক থেকে ইউরোপে বৈধ বা অবৈধভাবে ট্রেড ইউনিয়ন গঠিত হতে থাকে। অদক্ষ শ্রমিকরা অধিক সংখ্যায় ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে সংগঠিত হয়। শ্রমিক আন্দোলন ক্রমে জঙ্গী চরিত্র নিতে থাকে। ১৮৮৬ খ্রীঃ বেলজিয়ামের শার্লেরয় অঞ্চলে খনি ও কাচের কারখানায় শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের কয়েকদিন ধরে খণ্ডযুদ্ধ চলে। ১৮৮৯ খ্রীঃ লন্ডনে শ্রমিক-পুলিশ যুদ্ধ হয়। সরকার বাধ্য হয়ে ডক শ্রমিকদের মজুরী বাড়ান। এই ধর্মঘটে ইংলন্ডের ডক শ্রমিকরা দীর্ঘকাল ধৈর্য, ত্যাগ স্বীকার ও শৃঙ্খলার পরিচয় দেয়। ইংলণ্ডের দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে জার্মানীর হ্যামবুর্গের ডক শ্রমিকরা ধর্মঘট ও আন্দোলন করলে জার্মান মালিকশ্রেণী দৃঢ়তার সঙ্গে তা প্রতিহত করে।
১৮৯০-এর দশক থেকে ইউরোপ মহাদেশের শ্রমিক আন্দোলনে মার্কসবাদী সংগঠনের প্রভাব বাড়তে থাকে। জার্মান সোস্যাল ডেমোক্র্যাট দলই বেশীরভাগ ট্রেড ইউনিয়ন পরিচালিত করতে থাকে। রাশিয়ায় শ্রমিক আন্দোলনকে জার সরকার দৃঢ় হাতে দমন করলেও প্রতি কল-কারখানায় বলশেভিক ও সোস্যাল ডেমোক্র্যাটরা বে-আইনী গুপ্ত সংগঠন গড়ে তোলে। একমাত্র ইংলন্ডে ট্রেড ইউনিয়নগুলি শ্রমিক দল বা Labour Party-র নিয়ন্ত্রণে ছিল। ১৯০৫-এ রাশিয়ায় শ্রমিক বিদ্রোহকে জার সরকার কঠোর হাতে দমন করেন। ফ্রান্সের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন ঊনিশ শতকের শেষ দিকে সিন্ডিক্যালিষ্ট মতবাদের দ্বারা প্রভাবিত ছিল।
ঊনিশ শতকের শ্রমিক আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি রাশিয়া বাদে অন্য দেশগুলিতে পর্যালোচনা করে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, যদিও শ্রমিক নেতারা তাঁদের বক্তৃতা ও প্রবন্ধগুলিতে বিপ্লবের ডাক দেন ও পুরাতনতন্ত্র ভেঙে ফেলার কথা বলেন, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তাদের জঙ্গীপনা ছিল দুর্বল, তারা ছিলেন আপোষপন্থী। শ্রমিকদের কিছু দাবী-দাওয়া পূরণ হলেই তারা সন্তুষ্ট হতেন। তাদের এই প্রাগম্যাটিক (Pragmatic) দৃষ্টিভঙ্গীর ফলে তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থন পান এবং ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার লাভ করেন। দ্বিতীয়তঃ, ট্রেড ইউনিয়ন বা শ্রমিক সংগঠনগুলির নিজস্ব সম্পদ বহুগুন বাড়ে। শ্রমিকের চাঁদা ও অন্যান্য অনুদান থেকে শ্রমিক সংগঠনগুলি আর্থিক দিক থেকে পুষ্ট হয়। তাদের নিজস্ব সংবাদপত্র, অফিস, আমলাতন্ত্র গড়ে ওঠে। শ্রমিকদের জীবনের মানের উন্নয়ন ও মজুরী বৃদ্ধিই ছিল এই যুগের আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য। তৃতীয়তঃ, সকল শ্রমিককে এই যুগে ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য পদভুক্ত করা সম্ভব ছিল না। ১৯০০ খ্রীঃ ব্রিটেনে ২ মিলিয়ন, জার্মানীতে ৮৫০,০০০, ফ্রান্সে ২৫০,০০০ শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য ছিল। বাকি শ্রমিকরা ছিল অসংগঠিত।